Home Blog Page 25

শিব মাহাত্ম – পঞ্চানন শিব

শিব মাহাত্ম – পঞ্চানন শিব

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

শিবের পঞ্চানন রূপকে দুই ভাবে দেখা যায় বা ব্যাখ্যা করা যায়।প্রথমত পঞ্চানন রূপের অন্তর্নিহত অর্থ বা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা যে ব্যাখ্যা অনুসারে।দ্বিতীয়ত একজন লৌকিক দেবতা হিসেবে তার ব্যাখ্যা।আজ দুটি দিক নিয়েই লিখবো।

পাঁচ সংখ্যাটির সঙ্গে শিবের এক রহস্যময় ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে।শিবের পবিত্র সংখ্যা হল পাঁচ। পরম বৈষ্ণব শিবের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রগুলির একটি নমঃ শিবায় পাঁচটি অক্ষর দ্বারা গঠিত আবার শিবের শরীর পাঁচটি মন্ত্র দ্বারা গঠিত। এগুলিকে বলা হয় পঞ্চব্রহ্মণ।

পঞ্চানন রূপে শিবের পাঁচটি সত্তা বা রূপ প্রকাশিত হয়। এই পাঁচটি রূপ হলো

১- সদ্যোজাত
২- বামদেব
৩-অঘোর
৪- তৎপুরুষ
৫- ঈশান

বিভিন্ন শাস্ত্র অনুসারে আবার এই পাঁচটি রূপ পঞ্চভূত, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

দেবাদিদেবের পঞ্চানন রূপের আরো একটি ব্যাখ্যা হয় যেখানে পঞ্চানন শিবের এক লৌকিক রূপ। গ্রাম বাংলায় বহু জায়গায় পঞ্চানন শিবের মন্দির আছে। স্থানীয় ভাষায় তিনি “বাবাঠাকুর” নামে পরিচিত। আবার কারও কারও মতে তিনি “পাঁচু ঠাকুর”যিনি শিবের ই একটি বিশেষ রূপ।

গ্রাম বাংলায় লৌকিক দেবতা রূপে পূজিত পঞ্চানন ঠাকুরের সঙ্গে থাকেন তাঁর দুই অনুচর। ধনুষ্টংকার এবং জরাসুর নামক দুই অপদেবতা। এছাড়া থাকে ভূত-প্রেত, ঘোড়া ইত্যাদি পশু। যা
আবার অনেকের মতে তিনি শিবের পুত্র বা অবতার অনেকটা দক্ষযজ্ঞকালে জন্ম নেওয়া বীরভদ্রের মত।

ডোমজুড় সংলগ্ন প্রাচীন গ্রাম নারনা।
গ্রামের পশ্চিম দিকে রয়েছে বিরাট এক অশ্বত্থ গাছ। তার নীচে রয়েছে নারনা পঞ্চানন দেবের মন্দির। এককালে তুবারাম ঘোষ নামে এই গ্রামের এক বাসিন্দা পঞ্চানন দেবের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন যে পাশের পুকুরে দেবতা আছেন। পরদিন সকালে তিনি পুকুরে গিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন যে সেখানে একটি ঘট রয়েছে।
সেই ঘট স্থাপন করে শুরু হয় পুজো। পরবর্তীতে মন্দির এবং বিগ্রহ স্থাপন হয়। আজ এলাকাটি একটি তীর্থ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

বাবা পঞ্চাননের এমন অনেক প্রাচীন মন্দির আছে এই বাংলার বিভিন্ন স্থানে।বাংলার অন্যতম প্রাচীন তথা জনপ্রিয় লৌকিক দেবতা “ধর্মঠাকুর” আসলে শিবের পঞ্চানন রূপ বলেও অনেকে মনে করেন।

আসন্ন শিব রাত্রি উপলক্ষে শিব তীর্থ এবং শিব মাহাত্ম নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা চলতে থাকবে
ফিরে আসবো পরের পর্বে। পড়তে থাকুন।
ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

শিব তীর্থ – মথুরাপুরের বড়াশির শিব

শিব তীর্থ – মথুরাপুরের বড়াশির শিব

 

মথুরাপুর

 

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বড়াশির শিব মন্দির দক্ষিণ বঙ্গের অন্যতম প্রসিদ্ধ শিব মন্দির।এই মন্দিরে বিরাজ করেন বাবা বজুরকিনাথ শিব।

এই প্রাচীন শিব মন্দির নিয়ে বহু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে।

 

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মথুরাপুরের এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল সম্বন্ধে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। তবে মনে করা হয় শশাঙ্কের আমলে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে ব্রিটিশ যুগে সুন্দরবনের প্রাচীন এই মন্দির প্রথম সর্বসমক্ষে আসে। পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার এই অতি প্রাচীন মন্দিরের সংস্কার করা হয়েছে।জনপ্রিয়তাও দিনে দিনে বেশি হয়েছে।

 

স্থানীয়দের দাবি এই মন্দিরে বহু অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। একবার গরুরা নিজে দুধ দিয়েছিল। এখানকার শিবলিঙ্গের মাথায়।এলাকা যখন জঙ্গলাকীর্ণ ছিল তখন গরুর পাল এই মন্দিরের কাছে চলে আসত। সেই সময় এক রাখাল বালক গরুর খোঁজে মন্দিরের কাছে এসে দেখতে পান গরুর পাল নিজেরাই শিবলিঙ্গে দুধ দান করছে! এরপর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে বাবা মহাদেবের মাহাত্ম্যের কথা।আগে মন্দিরের পাশ দিয়ে বাবা ভোলানাথ স্বয়ং হেঁটে যেতেন এমন কথাও শোনা যায়।

 

এই মন্দিরে মানত করলে সব সমস্যার সমাধান হয় বলে বিশ্বাস। এর জন্য মানত করে পুণ্যার্থীরা মন্দিরের গায়ে ধাগা বাঁধেন। যা এখানে গেলেই দেখা যায়। মন্দিরের গায়ে সর্বত্র বাঁধা রয়েছে। শিব রাত্রি এবং চড়কের আগে ব্যাপক ভিড় এই মন্দিরে।বহু দুর দূরান্ত থেকে বাবা মহাদেবের ভক্তরা এই মন্দিরে আসেন তাদের মনোস্কামনা নিয়ে।

 

আবার যথা সময়ে ফিরে আসবো পরবর্তী শিব তীর্থ নিয়ে। চলতে থাকবে ধারাবাহিক শিব তীর্থ।

পড়তে থাকুন।ভালো থাকুন।ধন্যবাদ।

শিব তীর্থ – বুধেশ্বর শিব

শিব তীর্থ – বুধেশ্বর শিব

 

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

 

শিব তীর্থের আজকের পর্বে লিখবো

বাংলার প্রতিবেশী রাজ্য ছোত্রিশ গড়ে অবস্থিত এক অতি জাগ্রত ও জনপ্রিয় শিব মন্দির নিয়ে যা স্থানীয়দের কাছে বুধেস্বর শিব মন্দির নাম খ্যাত।

 

ছত্তিশগড়ের বিখ্যাত এবং ঐতিহাসিক শিব মন্দিরগুলির মধ্যে বুধেশ্বর মহাদেব মন্দিরের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।ছত্রিশ গড়ের রায়পুরের এই শিব মন্দিরের ইতিহাস প্রায় ছয়শো বছরের পুরনো।বুধেশ্বর মহাদেবের নামকরণ করা হয়েছে এক আদিবাসী দেবতার নামে।

 

এখানে একটি বহু প্রাচীন জলাশয় আছে। স্থানীয় আদিবাসীদের আরাধ্য দেবতা বুদ্ধদেবের নামানুসারে পুকুরটির নাম বুধতালাব বা বুধ পুকুর। এই পুকুরের পাড়ে একটি শিবলিঙ্গ ছিল এবং তার চারপাশে ভয়ঙ্কর বিষধর সাপ বাস করত এবং শিবলিঙ্গের চারপাশে সাপগুলি সর্বদা আবৃত থাকত। বুধতালাবের তীরে থাকায় শিবলিঙ্গটির নাম হয় বুধেশ্বর মহাদেব। পরবর্তীতে স্থানীয় আদিবাসিদের উদ্যোগে পুকুরের পাড়ে একটি ছোট মন্দির তৈরি করে শিবলিঙ্গকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বুধেশ্বর মন্দিরে দুশো বছরের পুরনো একটি বটগাছ রয়েছে।এই বট গাছের গোড়াটি অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হয় এবং বিশেষ কিছু তিথিতে সেখানেও বিশেষ পুজোর আয়োজন হয়।

 

মহাশিবরাত্রির সময়ে অসংখ্য ভক্ত এই মন্দির দেখার জন্য ভিড় করেন।মহাশিবরাত্রির সকালে শিবলিঙ্গে ভস্ম আরতি করা হয়।শিব রাত্রিতে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত হয় জলাভিষেক এবং সন্ধ্যায় গাঁজা, ধুতুরা অর্পণ করার পাশাপাশি এখানে রূপার সাপ নিবেদন করার রীতি আছে।

 

আবার শিব তীর্থ নিয়ে ফিরে আসবো পরের পর্বে। এখনো অনেক শিব মন্দির নিয়ে আলোচনা

বাকি আছে। পড়তে থাকুন।

ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

শিব তীর্থ – রাজরাজেশ্বর শিব

শিব তীর্থ – রাজরাজেশ্বর শিব

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

প্রায় আড়াইশো বছরের পুরোনো গৌরবময় রাজ রাজেশ্বর মন্দির রয়েছে নদিয়ার কৃষ্ণ নগরের কাছে শিব নিবাসে যে মন্দিরের সাথে জড়িত আছে অনেক ইতিহাস অনেক কিংবদন্তী।

শোনা যায় যে কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নসরত খাঁ নামে এক ডাকাতকে দমন করতে কৃষ্ণগঞ্জের কাছে গভীর বনের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন রাতে আহার করার পর পাশে বয়ে যাওয়া চূর্নী নদীতে মুখ ধুচ্ছিলেন রাজা মশাই সেই সময় একটি রুই মাছ তার কাছে চলে আসে। তাই দেখে এক রাজ কর্মচারী বলেন যদি এখানে বসবাস করেন তবে রাজার ভালোই হবে।কথাটা রাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের মনে ধরে।পরবর্তীতে নিজের রাজ্য মারাঠাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য  সাময়িকভাবে কৃষ্ণনগর থেকে শিবনিবাসে তার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন মহারাজা কৃষ্ণ চন্দ্র।

জনশ্রুতি আছে মহাদেবের সপ্নাদেশ পেয়ে তাকে সন্তুষ্ট করতে মহারাজা শিবনিবাসে মন্দির স্থাপন করেছিলেন। মন্দিরের নাম রাখা হয় রাজ রাজেশ্বর মন্দির।এই মন্দিরে স্থাপিত শিবলিঙ্গ এশিয়ার বৃহত্তম বলে মনে করা হয়। রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পরে মহারাজা সম্ভবত এই জায়গাটির নাম শিবনিবাস নামকরণ করেন।  আবার অনেকে বলেন এই নামটি তাঁর পুত্র শিবচন্দ্রের নামে রাখা হয়েছিল।

মন্দিরের চূড়া সমেত উচ্চতা একশো কুড়ি ফুট।মন্দিরের ভিতর কালো শিবলিঙ্গ যার উচ্চতা প্রায় বারো ফুট এবং বেড় ছত্রিশ ফুট। সিঁড়ি দিয়ে উঠে শিবের মাথায় জল ঢালতে হয়।
শিবভক্তরা শ্রাবণ মাসে প্রতি সোমবার নবদ্বীপের গঙ্গা থেকে জল নিয়ে হেঁটে শিবনিবাসে এসে শিবের মাথায় জল ঢালেন। শিব রাত্রিতেও বিশেষ পুজো হয়। নদীয়া তথা বাংলার ঐতিহাসিক এবং প্রাচীন শিব মন্দিরগুলির মধ্যে এটি
অন্যতম জনপ্রিয় শিব তীর্থ

ফিরে আসবো শিবতীর্থ নিয়ে আগামী পর্বে।
শিবরাত্রি উপলক্ষে চলতে থাকবে এই
ধারাবাহিক আলোচনা। পড়তে থাকুন।
ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

শিব তীর্থ – চক্রেশ্বর শিব

শিব তীর্থ – চক্রেশ্বর শিব

 

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

 

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক শহর রাজ্য তথা দেশের অন্যতম প্রাচীন শহর। যার প্রাচীন নাম ছিল তাম্রলিপ্ত নগরী। এই শহরেই আছে বহু প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক চক্রেশ্বর শিব মন্দির।

 

এই চক্রেশ্বর শিব লিঙ্গের উল্লেখ আছে মহাভারত সহ একাধিক প্রাচীন গ্রন্থে। জেলার অন্যতম প্রাচীন এই শিব মন্দির তমলুকের মানুষের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এবং তাৎপর্যপূর্ণ।আজও ইতিহাসের আকর্ষনে বা ভক্তির টানে বহু মানুষ ছুটে আসেন এই মন্দিরে।

 

আগেই বলছি এই শিব মন্দিরের নিদর্শন পাওয়া যায় মহাভারতে। কথিত আছে পান্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময় পঞ্চপান্ডবসহ কুন্তী ও দৌপ্রদী পুজো দিয়েছিলেন এই শিব মন্দিরে।চক্রেশ্বর মন্দির মোট চারটি শিবের লিঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়। জানা যায় তার মধ্যে একটি স্বয়ং প্রকটিত হয়েছে। অর্থাৎ স্বয়ম্ভু।কথিত আছে বাকি তিনটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যুধিষ্ঠির ভীম ও অর্জুন।তারাই পুজো শুরু করেন এই মন্দিরে। আজও সেই পরম্পরা বয়ে নিয়ে চলেছেন তমলুকের মানুষ।

 

চক্রেশ্বর নামের সাথেও যোগ রয়েছে মহাভারতের শোনা যায় মহাদেবের চক্রান্তের কারণেই গান্ধারী পূজা দিতে পারেনি এই মন্দিরে তাই গান্ধারী নাম রাখেন চক্রেশ্বর। তিনি এই মন্দির সংক্রান্ত একটি পুকুরকেও অভিশাপ দিয়ে বলেন যে তার জলও পুজোয় কাজে লাগবেনা। সেই পুকুরের জল আজও দূষিত এবং শুভ কাজে ব্যবহার হয়না।

 

বর্তমানে চক্রেশ্বর শিব মন্দিরে প্রতিদিন নিত্য পুজো হয় এর পাশাপাশি প্রতি সোমবার বিশেষ পুজো পাঠ চলে। শিবরাত্রি ও চৈত্র মাসের নীল সংক্রান্তির পূজো হয় এই মন্দিরে। সেই সময়ে অসংখ্য শিব ভক্তর আগমন ঘটে এখানে।

 

ফিরে আসবো শিব তীর্থ নিয়ে আগামী পর্বে। থাকবে অন্য একটি প্রাচীন শিব মন্দিরের ইতিহাস এবং আরো অনেক তথ্য। পড়তে থাকুন।

ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

শিব তীর্থ – নর্তকেশ্বর শিব

শিব তীর্থ – নর্তকেশ্বর শিব

 

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

 

শিবের নটরাজ রূপের পুজো বাংলায় খুব একটা হয়না ঠিকই তবে পূর্বভারতে একসময় ‘নর্তকেশ্বর’ নামক নৃত্যরত শিবমূর্তির পূজা প্রচলিত ছিল।আজকের পর্বে আপনাদের এমনই

এক শিবমূর্তির ইতিহাস জানাবো।

 

দশম শতকের শেষভাগে পালবংশের রাজা যখন মহীপাল। তখন বাংলা আক্রমণ করলেন সে যুগের ভারতবর্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা চোলরাজ রাজেন্দ্র।চোলরাজ রাজেন্দ্র ছিলেন শিব ভক্ত ।

তাই তার সেনাবাহিনী সোনাদানা বা মূল্যবান রত্ন ছাড়াও বঙ্গবিজয়ের আরও একটি স্মারক নিয়ে যান নিজের রাজ্যে। সেটি হল, নর্তকেশ্বরের বিগ্রহ।

সেই অদ্ভুত সুন্দর শিব মূর্তি দেখে অত্যান্ত খুশি হন চোল রাজা। তার ইচ্ছায় তামিলনাড়ুর অমৃতঘটেশ্বর মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হলেন বাংলার শিবঠাকুর।

 

সেই মূর্তি ছিলো শিবের নৃত্যরত রূপের

যাকে বলা হতো নর্তকেশ্বর শিব।এই নর্তকেশ্বর শিব মূর্তি মূর্তি মূলত দুইপ্রকার। দশভুজ নর্তকেশ্বর এবং দ্বাদশভুজ নর্তকেশ্বর।দুটি মূর্তিই অত্যান্ত দুর্লভ।বাংলা থেকে নিয়ে যাওয়া সেই শিব মূর্তি ছিলো দশভুজ নর্তকেশ্বর।

 

অপূর্ব সেই ধাতব বিগ্রহ বৃষরূপী নন্দীশ্বরের পৃষ্ঠে ললিত তাণ্ডবে মত্ত নর্তকরাজ, তাঁর বাহনটি ঊর্ধ্বমুখ হয়ে দেখছে সেই নৃত্যলীলা। মহেশ্বরের মাথায় জটামুকুট, স্কন্ধে নাগ-উপবীত তাঁর মুখ্য দক্ষিণহস্তে রয়েছে গজহস্ত মুদ্রা, বাম হাত উপরে তুলে পতাকামুদ্রায় তার ভক্তদের অভয় দিচ্ছেন। অন্য আটটি হাতে রয়েছে ধনুর্বাণ, খড়গ-চর্ম, ত্রিশূল, খট্টাঙ্গ, কপালপাত্র আর অঙ্কুশ।

তাঁর পায়ের কাছে, তাঁকে ঘিরে রয়েছেন গণপতি, স্কন্দ এবং অন্যান্য অদ্ভুতদর্শন শিবানুচরের দল। মহাদেবের প্রভামণ্ডলের দক্ষিণাংশে শূন্যে মরালপৃষ্ঠে বিরাজ করছেন বীণাধারিণী সরস্বতী, ঊর্ধ্বভাগে হাতে পুষ্পমালা নিয়ে ভেসে রয়েছেন দুই বিদ্যাধর।

 

এমন ধরণের নর্তকেশ্বর রূপে শিব মূর্তি প্রাচীনকালে বাংলার আরো অনেক স্থানে দেখা যেতো তবে বর্তমান সময়ে এই মূর্তি বাংলায় খুব একটা দেখা যায়না। বাংলার নর্তকেশ্বর শিব মূর্তির একটি বৈশিষ্ট ছিলো দুইপাশে দণ্ডায়মানা দুই দেবী দক্ষিণভাগে মকরবাহিনী গঙ্গা এবং বামভাগে সিংহবাহিনী উমা।এই মূর্তির দর্শন পাওয়া খুবই সৌভাগ্যের বিষয় কারণ অতি দুর্লভ এই

শিব মূর্তি।

 

বাংলার শিব মূর্তি এবং শিব মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে আবার ফিরে আসবো আগামী পর্ব

গুলিতে। পড়তে থাকুন।

ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

শিব তীর্থ – দক্ষিনেশ্বরের বুড়ো শিব

শিব তীর্থ – দক্ষিনেশ্বরের বুড়ো শিব

 

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

 

দক্ষিনেশ্বর লাগোয়া গঙ্গার ধারে রয়েছে এক অতি প্রাচীন শিব মন্দির যার প্রতিষ্ঠা কাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়না তবে মনে করা হয় এই শিব লিঙ্গ ২০০০ বছর পুরোনো। আজকের পর্বে এই প্রাচীন শিব লিঙ্গ প্রসঙ্গে আলোচনা করবো।

 

বাংলার তখন হোসেন শাহর শাসন চলছে। এই অঞ্চলে বসবাসকারী এক ব্রাহ্মনকে বাবা মহাদেব স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন আমি বহু দিন জঙ্গলে অযত্নে আছি। আমাকে মন্দির নির্মাণ করে পুজো করো। পরদিন সেই স্বপ্নের কথা জানাজানি হয়। অনেক খোঁজার পরে আরিয়াদহর কাছে জঙ্গলে এই শয়ম্ভু শিব লিঙ্গ পাওয়া যায় এবং মন্দির

স্থাপন করে পুজো শুরু হয়।

 

পরবর্তীতে বান রাজাদের আমলে নতুন করে মন্দির তৈরী হয়। শিবের স্বপ্নাদেশেই সেই মন্দিরে চূড়া রাখা হয়নি।পরবর্তীততে একাধিকবার এই মন্দির সংস্কার করা হয় এবং মন্দিরের উত্তর দিকে একটি বানলিঙ্গ স্থাপিত করা হয়।

 

শোনাযায় একবার ব্রিটিশ আমলে বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিং এই শিব লিঙ্গ তুলে গঙ্গায় ফেলে দিতে চেয়ে ছিলেন কিন্তু বহু খোঁড়াখুঁড়ি করেও এই শিব লিঙ্গের তল খুঁজে পাওয়া যায়নি। ব্যার্থ হয়ে সেই সময় ওয়ারেন হেস্টিং ফিরে গেছিলেন।

 

এই শিব লিঙ্গকে দক্ষিনেশ্বর শিব লিঙ্গ বলা হতো। এবং মনে করা হয় এই শিবের নামেই এই স্থানের নাম হয় দক্ষিনেশ্বর।আজও প্রতি শ্রাবন মাসে এবং শিব রাত্রিতে এখানে বিশেষ পুজো হয়।

 

আবার ফিরে আসবো শিব তীর্থ নিয়ে। শিব রাত্রি উপলক্ষে শিব মাহাত্ম এবং শিব মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা।

চলতে থাকবে।পড়তে থাকুন।

ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

শিব তীর্থ – মুকুটেশ্বর শিব 

শিব তীর্থ – মুকুটেশ্বর শিব

 

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

 

আজকের পর্বে বাংলার আরো একটি প্রসিদ্ধ শিব মন্দিরের মহিমা বর্ণনা করবো।মুর্শিদাবাদের অন্যতম জনপ্রিয় এবং প্রাচীন শিব মন্দির মুকুটেশ্বর শিব যার ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয়

গুরুত্ব অপরিসীম।

 

ঠিক কবে মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল তার সুনির্দিষ্ট তথ্য বর্তমান সেবায়েতদের কাছে নেই। এমনকি প্রবীণদের‌ও সেই উত্তর অজানা। কথিত আছে প্রায় দুশো বছর আগে বাঘডাঙার রাজা এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

 

এই মন্দির নির্মাণ নিয়ে রোমাঞ্চকর এক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে।শোনা যায় আগে মসড্ডা গ্রামের মাঝামাঝি জায়গা ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল। সেই সময়ে মুকুট ঘোষ নামে গ্রামের এক গো পালক তার হারানো গরু খুঁজতে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পান তিনি দেখেন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজে থেকেই দুধ দিচ্ছে ওই গরুটি। এতো দুধ দিয়েছে যে সেই এলাকার মাটি ভিজে গেছে।মুকুট ঘোষ বিষয়টি কাউকে না জানিয়ে পরেরদিন একা একা জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে তার গাইয়ের দুধে ভিজে ওঠা জায়গাটা খুঁড়তে শুরু করেন।সেখানে তিন ফুট গভীর গর্ত খোঁড়ার পর তিনি দেখতে পান একটি শিবলিঙ্গ। সেই রাতে তিনি স্বপ্নদেশ পান যে ওই স্থানে একটি মন্দির নির্মাণ করতে হবে এবং মন্দিরের নাম হবে মকুটেশ্বর।

 

যে সময় মুকুট ঘোষ স্বপ্নাদেশ পান সেই সময়ে অদ্ভুত ভাবে মুর্শিদাবাদের কান্দি রাজপরিবারের এক সদস্য‌ও স্বপ্নাদেশ পান যে মন্দির গড়ার জন্য অর্থ যোগান দিতে হবে। নির্দেশ মতো রাজ পরিবারের অর্থে মন্দির নির্মাণ হয়।সেই সময় থেকে মকুটেশ্বর মন্দিরের পুজো শেষে প্রসাদ সেই রাজপরিবারে নিয়ে যেতে হত সেবায়েতদের।আজও সব রীতি আগের মতনই আছে।

শ্রদ্ধা এবং ভক্তিআছে অটুট।

 

এই মন্দিরে করা সব মনোস্কামনা পূর্ণ হয় এমনটাই স্থানীয়দের বিশ্বাস।শ্রাবণ মাসের সোমবার এবং বিভিন্ন বিশেষ দিনে শিব ভক্তরা আসেন মন্দিরে পুজো দিতে।শিব রাত্রি এবং চৈত্র

মাসেও বহু মানুষের ভিড় হয় এছাড়া

নীল ষষ্ঠীতে বিশেষ পুজো এবং উৎসব হয়।

 

আবার ফিরে আসবো শিব তীর্থ নিয়ে

আগামী পর্বে। এখনো বাংলার বহু প্রাচীন শিব মন্দির নিয়ে আলোচনা

বাকি আছে।পড়তে থাকুন।

ভালো থাকুন।ধন্যবাদ

শিব তীর্থ – অচলেশ্বর শিব

শিব তীর্থ – অচলেশ্বর শিব

 

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

 

আসন্ন শিব রাত্রি উপলক্ষে ধারাবাহিক ভাবে শুরু করছি দেশের প্রসিদ্ধ শিব তীর্থ গুলি নিয়ে আলোচনা।আজকের পর্বে বলবো একটি রহস্য ময় শিব মন্দির নিয়ে তবে তার আগে শিব তত্ত্ব নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।

 

শিব দেবতাদের আরাধ্যা কিন্তু তিনি তাহলে সর্বদা কার ধ্যান করেন?সনাতন ধর্মে দেবতা ও দেবী কয়েক কোটি হতে পারে কিন্তু ভগবান একজনই তিনি কৃষ্ণ, আমরা জানি যিনি বিষ্ণু তিনিই কৃষ্ণ, তিনিই নারায়ন |তিনিই শিবের আরাধ্য|শিব তার ধ্যানেই মগ্ন থাকেন|শিব নিজে একজন পরম বৈষ্ণব|এই শ্রেষ্টত্ব নিয়ে অবশ্য শৈব্য ও বৈষ্ণবদের মাঝে মাঝেই বিরোধ দেখা দেয়|তবে সব বিবাদের সমাধান শিব নিজেই দিয়েছেন|দেবী পার্বতী একদিন শিব কে প্রশ্ন করেছিলেন যে তিনি কার ধ্যান করেন, উত্তরে শিব বলেন তিনি শ্রী শ্রী হরির ধ্যান করেন।

 

এবার আসি আজকের শিব ভূমি অচলেশ্বর শিব মন্দিরের কথায়, কয়েকটি বিশেষ কারনে এই মন্দির বেশ রহস্যময় সে বিষয়ে পরে আসছি আগে এই মন্দির নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আপনাদের সাথে ভাগ করে নিই|রাজস্থানের সিরোহী জেলায় অচলগড় কেল্লার ঠিক বাইরেই এই মন্দিরের অবস্থান। অচলেস্বর শিব মন্দির নামেই বিখ্যাত এই মন্দির|

 

মহাদেবের একটি পায়ের ছাপকে কেন্দ্র করে এই মন্দিরটি গড়ে ওঠে|নবম শতকে তৈরি হয় এই মন্দির|নন্দীর মূর্তির পাশাপাশি মন্দিরের মধ্যে রয়েছে একটি স্তূপ স্থানীয়দের বিশ্বাস এই স্তূপটি আদপে নরকের দক্ষিণ দ্বার|পাশেই রয়েছে একটি পুকুর। পুকুরের পাড়ে রয়েছে তিনটি ধাতব মহিষের মূর্তি। বলা হয়,এই তিনটি মূ্র্তি আসলে তিনটি রাক্ষসের প্রতিরূপ যারা এই মন্দির আক্রমন করে ও স্বাস্তি স্বরূপ পাথরে পরিণত হয়|ইতিহাস অনুসারে অতীতে বৈদেশিক আক্রমনের শিকার হয়েছে এই মন্দির কিন্তু রক্ষা পেয়েছে অলৌকিক ভাবে|এই মন্দিরের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তুটি এর ভিতরে থাকা শিবলিঙ্গটি।দিনের বিভিন্ন সময়ে এর রং থাকে বিভিন্ন রকমের। দিনে অন্তত তিন বার রং বদলায় এই শিবলিঙ্গ। সকাল বেলা এর রং থাকে লাল, বিকেলে হয় জাফরান, আর রাত্রে এর রং হয় কালো|আরো একটি রহস্যময় ঘটনার উল্লেখ পাওয়াযায় এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে|একবার গর্ভগৃহটি সংস্কারের সময় খোঁড়াখুঁড়ি করতে গিয়ে গর্ভগৃহ বেষ্টন করে থাকা একটি সুড়ঙ্গ আবিষ্কৃত হয়। সুড়ঙ্গের মধ্যে দু’টি কুলুঙ্গিতে পাওয়া যায় দেবী চামুণ্ডার দু’টি মূ্র্তি। দেখা যায়, মূর্তি দু’টিতে লেপা রয়েছে সিঁদুর। যেন সদ্য পূজিতা হয়েছেন দেবী|এও এক রহস্য যার সমাধান আজও সম্ভব হয়নি|

 

আবার ফিরে আসবো শিব তীর্থ নিয়ে আগামী পর্বে। পড়তে থাকুন।ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

শিব তীর্থ – নবাবহাটের একশো আটটি শিব মন্দির

শিব তীর্থ – নবাবহাটের একশো আটটি শিব মন্দির

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

বর্ধমানের নবাবহাটে রয়েছে ১০৮ টি প্রাচীন শিব মন্দির। মন্দির গুলি জপমালার মতো পরপর বসানো ১০৮টি শিব মন্দির, জড়িয়ে রয়েছে বহু প্রাচীন ইতিহাস এবং কিংবদন্তী। আজকের পর্বে আলোচনা করবো এই একশো আট
শিব মন্দির নিয়ে।

শোনা যায় বর্ধমানের এই নবাব হাট এলাকা নাকি একসময় জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল। কেউ যেত না সেই গ্রামে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারীর কারণে এলাকায় ছিল না জনবসতি। প্রজাদের বাঁচাতে
এবং মনের ভয় দুর করতে বর্ধমানের মহারাজা ১০৮ শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

বিরাট অংশজুড়ে থাকা শিব মন্দির পর পর রাখা রয়েছে রুদ্রাক্ষের মালার আদলে।ঠিক যেনো এক বিরাট আকৃতি জপ মালা কেউ মাটিতে ছড়িয়ে রেখেছে।

একটি আলাদা শিব মন্দিরও আছে এখানে সেটি যোগ করলে সংখ্যা দাঁড়ায় ১০৯। এই ১০৯তম মন্দিরটি প্রতিষ্ঠার সময় সেখানে লক্ষ সাধুর উপস্থিতি ঘটেছিল। তাঁদের পদধূলি রাজপরিবার একটি সোনার কলসিতে
সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন ।

অনেকে আবার মনে করেন রানি বিষ্ণুমতির সঙ্গে এক সময় ইংরেজদের সমস্যা হয়। শুরু হয় দ্বন্দ্ব। সেই সময় রানি স্বপ্নাদেশ পান মন্দির প্রতিষ্ঠার। সেই সূত্রেই পলাশীর যুদ্ধের কয়েক বছর পর নবাবহাটে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়।

বর্তমানে মন্দিরে পুরোহিত রয়েছেন দু’জন। প্রতিদিন তাঁরাই এক-একটি মন্দিরে পুজো করেন। গোটা মন্দির চত্বর ঘুরে ঘুরে পুজো করতে সময়ে লাগে প্রায় দু ঘণ্টা।

শিব এখানে যে রূপে এখন পূজিত হন, সেই রূপ মূলত প্রাক-বৈদিক যুগ ও বৈদিক যুগের মিশ্র সংস্করণ।মন্দিরগুলির অবস্থান যেমন পাশাপাশি, তেমনি প্রতিটি মন্দিরের সামনেই আছে খোলা টানা বারান্দা। প্রতিটি মন্দিরই একটি দরজার। সব মন্দিরেই রয়েছে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ। শোনা যায় প্রতিষ্ঠার সময়ে সবগুলি মন্দিরের সামনেই একটি করে বেল গাছ রোপন করা হয়েছিল।

বর্ধমানের শিব মন্দিরগুলিতে সারা বছরই পুণ্যার্থীদের ভিড় থাকে। বিশেষ করে শিব রাত্রির সময়ে অনেক মানুষের ভিড় হয়।

ফিরে আসবো অন্য এক শিব মন্দিরের ইতিহাস এবং সেই সংক্রান্ত আলোচনা নিয়ে
আবার আগামী পর্বে। পড়তে থাকুন।
ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।