পুরান রহস্য – নারদ মুনি কে?

6904

হিন্দু ধর্মের অসংখ্য দেব দেবী ও পৌরাণিক চরিত্র দের মধ্যে এক রহস্যময় ও ব্যতিক্রমী চরিত্র দেবর্ষি নারদ |তিনি এক জনপ্রিয় পৌরাণিক চরিত্র, আচার আচরণে তিনি পরম বৈস্নব |মুখে সদা হরিনাম, সর্বত্র তার অবাধ যাতায়াত, সব সংবাদ, সব জ্ঞান তার মধ্যে সদা বর্তমান |দেব লোক থেকে জমলোক সব স্থানে তিনি সমান জনপ্রিয় | কিন্তু তিনি দেবতা হিসেবে পূজিত হন না| তাকে নিয়ে আছে হাজার বিতর্ক আছে অনেক বদনাম ও |কিন্তু কে তিনি? কি তার স্বরূপ? কোথাথেকে তার উৎপত্তি? আমরা অনেকেই এই প্রশ্ন গুলির সঠীক উত্তর জানিনা বা কখনো জানার চেষ্টা করিনি | আজ পুরান রহস্যর এই পর্বে জানবো দেবর্ষি নারদের কথা|

সৃষ্টির একদম আদি লগ্নে সৃষ্টি কর্তা ব্রহ্মা প্রজাপতিদের সৃষ্টি করেন সৃষ্টি কার্যে তাকে সাহায্য করার জন্য । এই প্রজাপতিরাই মানবজাতির আদিপিতা।ব্রম্হার মন থেকে এদের সৃষ্টি তাই এদের ব্রম্হার মানসপুত্র বলাহয়, মনুস্মৃতি তে এদের উল্লেখ আছে । এঁরা হলেন মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরস, পুলস্ত, পুলহ, ক্রতুজ, বশিষ্ঠ, প্রচেতস বা দক্ষ, ভৃগু ও নারদ। এই ভাবে মহর্ষি নারদ এর জন্ম হয় একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে|কিন্তু ঈশ্বর সাধনা ও ভগবৎপ্রাপ্তিতে বিঘ্ন সৃষ্টির আশঙ্কায় তিনি তাতে রাজি না হওয়ায়, ব্রহ্মার অভিশাপে নারদকে গন্ধর্ব ও মানবযোনিতে জন্মগ্রহণ করতে হয়েছিলো। এছাড়া নারদের জন্ম নিয়ে বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন উল্লেখ রয়েছে।ব্রহ্মাবৈবর্ত পুরাণে এই ঘটনার সব থেকে সুন্দর বর্ণনা রয়েছে |আবার কোথাও নারদ প্রজাপতি ব্রহ্মা ও দেবী সরস্বতীর সন্তান।

কিছু শাস্ত্রে তার জন্ম বৃত্তান্ত সামান্যআলাদা,এঁর জন্ম হয়ে ছিল ব্রহ্মার কণ্ঠ থেকে।প্রথমে ব্রহ্মা তাঁকে সৃষ্টির ভার দেন। সৃষ্টির কাজে ব্যস্ত থাকলে ঈশ্বর চিন্তা বিঘ্নিত হবে বিবেচনা করে ইনি ব্রহ্মার আদেশ মানতে রাজী হলেন না। ফলে ব্রহ্মা তাঁকে অভিশাপ দিয়ে বলেন যে, নারদকে গন্ধমাদন পর্বতে গন্ধর্বযোনিতে জন্মগ্রহণ করতে হবে।যথা সময়ে ইনি গন্ধর্বযোনিতে জন্মগ্রহ করেন।এই সময় তাঁর নাম ছিল উপবর্হণ।

নারদের বাহন ঢেঁকী, এইরূপ প্রবাদ প্রচলিত, কিন্তু শাস্ত্রে তার বিশেষ প্রমাণ পাওয়া যায় না । এই প্রবাদের মূলে কোন সত্য আছে কি না, তাছা নির্ণয় করা কঠিন ।তবে তার যে চিত্র পুরানে বর্ণনা করা হয়েছে সেখানে তার বাহন সমেত তিনি স্বমহিমায় বিরাজমান |এই বাহন এ চড়েই তাকে এক লোক থেকে আরেক লোকে ছুটে বেড়াতে দেখাযায় সর্বদা

কিছু হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে- ব্রহ্মার মানসপুত্র নারদ একজন ত্রিকালজ্ঞ, বেদজ্ঞ ও তপস্বী|তার বৈরাজ্ঞ ও জ্ঞানের জন্য তিনি দেবর্ষি উপাধিতে ভূষিত ।তার নামের ও একটা অর্থ আছে নার শব্দের অর্থ জল।ইনি সবসময় তর্পণের জন্য জলদান করতেন বলে এঁর নাম হয় নারদ।

বহু গুরুত্বপূর্ণ পৌরাণিক ঘটনার সাথে তিনি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, বিভিন্নস্থানে বিভিন্ন ভূমিকায় দেখা যায় তাকে । ইনি কৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্ত পূর্বেই কংসকে জানিয়েছিলেন,ধ্রুবের তপস্যায় মন্ত্রদাতা ছিলেন, মহাদেব-পার্বতীর বিবাহের ঘটক ছিলেন, দক্ষের অহঙ্কার নাশে ইনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। আবার রাময়ণের মূল কাহিনী তিনি বাল্মীকিকে শুনিয়েছিলেন। পরে এই কাহিনী অবলম্বনে বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করেছিলেন।

এছাড়া ইনি দূত হিসাবেও বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।কথিত আছে ইনি কথা গোপন করে রাখতে পারতেন না, এজন্য তিনি শাস্ত্রে নানা ভাবে বহুবার সমালোচিত হয়েছেন । কখনো কখনো অবিবেচকের মতো কথা বলে, বিপর্যয় ডেকে আনতেন। কংসের কাছে কৃষ্ণের জন্মগ্রহণ এবং কৃষ্ণকর্তৃক কংসবধের কথা বলেছিলেন।যার ফলে ফলে কংস চরম অত্যাচারি হয়ে উঠেছিলো, অন্ধকার নেমে এসে ছিলো দেবকী ও বাসুদেবের জীবনে, এমনকি বিন্ধ্যপর্বতের কাছে সুমেরুর গুণকীর্তন করে, পৃথিবী বিপর্যস্ত করেন।পরে এই বিপর্যয় থেকে অগস্ত্য মুনি পৃথিবী রক্ষা করেন পৃথিবী কে|সে গল্প আমরা পরে কখনো শুনবো |

সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক চরিত্র এই দেবর্ষি নারদ দেবলোক আর মানবলোকের মধ্যে এক প্রকার সংযোগসেতু। তিনি মানবের যাবতীয় সংবাদ দেবলোকে পৌঁছন আবার দেব লোকের সংবাদ অন্যত্র পৌঁছে দেন । এমন বর্ণনাই রয়েছে পুরাণাদি গ্রন্থে।বিভিন্ন দেবতা ও মানবের মধ্যে ঝগড়া বাধানোর যে বদনাম নারদের উপরে আরোপ করা হয়, তা প্রকৃত অর্থে সত্য নয়। তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কখনই বৈরিতার জন্ম দেননি। তর্ক ও বিসংবাদের মধ্যে দিয়ে যাতে সত্য উদঘাটিত হয় এবং অধর্মের উপর ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয় তিনি সেই কাজই করেছেন। এই প্রক্রিয়া ভারতীয় সংস্কৃতিতে মান্যতাপ্রাপ্ত।তাছাড়া তিনি বিষ্ণু ভক্ত, ভগবানের লীলায় তিনি সহায়ক হয়েছেন মাত্র |তিনি সদা কৃষ্ণ নাম করেছেন ও নাম বিলিয়েছেন, ভক্তি মার্গে চলতে উৎসাহ দিয়েছেন সবাই কে, পাপ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন সর্বদা |যেকোনো কার্যে তিনি নিমিত্ত মাত্র, যাই হয়েছে তা ভগবান এর ইচ্ছায় হয়েছে |

টিভির পর্দায়, সাহিত্যে বা সিনেমায় তাকে কিছুটা বিকৃত করেই দেখানো হয়েছে মানুষ কে আনন্দ দেয়ার জন্য তাই বর্তমান প্রজন্মের কাছে তার স্বরূপ ধরা দেয়নি সে ভাবে | তিনি প্রকৃত অর্থে ভক্তি, জ্ঞান ও বৈরাজ্ঞর প্রতীক |আজ দেবর্ষি নারদের কথা এখানেই শেষ করছি, ফিরবো আগামী পর্বে নতুন কোনো চরিত্র এবং তার জড়িয়ে থাকা অনেক গল্প ও রহস্য নিয়ে|পড়তে থাকুন, যোগাযোগ করুন উল্লেখিত নাম্বারে ও কথা বলুন জ্যোতিষ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে, ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|