Home Blog Page 53

গুরু কথা – ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

গুরু পূর্ণিমা উপলক্ষে দেশের আধ্যাত্মিক গুরুদের নিয়ে যে আলোচনা শুরু করেছি তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি প্রেমের ঠাকুর ও বাংলার আধ্যাত্মিক জগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব প্রসঙ্গে না বলি|গুরু পূর্ণিমার ঠিক আগে আজ বলবো এই মহান গুরুর কথা|ইংরেজির ১৮৩৬ সালে একটি সাধারণ বাঙালি গ্রামীণ পরিবারে জন্মগ্রহণকারী রামকৃষ্ণ ছিলেন একজন যোগসাধক, দার্শনিক ও ধর্মগুরু। তিনি উনিশ শতকের এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি বাঙালি নবজাগরণে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তার গর্ভে থাকাকালীন তার বাবা-মা তার অলৌকিক উপস্থিতি অনুভব করেছিলেন এবং যেমনটি প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তিনি শৈশবকালেই রহস্যময় ও অলৌকিক শক্তির অভিজ্ঞতা অর্জন শুরু করেছিলেন। শ্রী রামকৃষ্ণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসেছিলেন তার লীলা করতে, পরমহংসদেব যখন জগৎ সমক্ষে উদয় হন, তখন ঘোরতর ধর্মবিপ্লব চলছে চারপাশে, “জড়বাদী মুক্তকণ্ঠে বলছেন – “জড় হইতেই সমস্ত,জড়ের সংযোগেই আত্মা, জড় ব্যতীত আর কিছু নাই “ব্রাহ্ম সমাজ বলছে – “বেদ, বাইবেল, কোরান প্রভৃতি কিছুই মানিবার আবশ্যক নাই, কোনটিই অভ্রান্ত নয়, কোনটিই ঈশ্বর বাক্য নয়”এমন সময় পরমহংসদেব প্রচার করলেন “কোন ধর্ম কোন ধর্মের বিরোধী নয়। বাহ্য দৃষ্টিতেই বিরোধ কিন্তু সকল ধর্মই মূলত এক কথা বলেআরো সহজ করে বললেন ” যত মত ততো পথ “কথিত আছে, ঠাকুর যখন জন্মগ্রহন করেছিলেন, কামারপুকুর বাটিতে তাদের শিব মন্দির চন্দ্রালোতে আলোকিত হয়ে উঠেছিল। রামকৃষ্ণদেবের গড়নে ছিল দৈবিকভাব|সেটাই স্বাভাবিক, তিনি কোনো স্বাভাবিক মানুষ ছিলেন না, একাধারে সাধক ও দার্শনিক এই মানুষ টাকে হয়তো এখনো বাঙালি ঠিক চিনে উঠতে পারেনি, তার অবতার তত্ত্ব নিয়েও দ্বিমত আছে, তবে, সাধনার যে উচ্চস্তরে তিনি গিয়েছিলেন তা, কল্পনা করা কঠিন|তার দক্ষিনেশ্বর মন্দিরে থাকা কালীন অদ্ভুত এক অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছিলেন ঠাকুর|দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক মথুর বিশ্বাস একবার রামকৃষ্ণের কাছে আব্দার করেন যে, ঠাকুরের যেমন ভাবসমাধি হয়, তেমনই ভাবসমাধির অভিজ্ঞতা লাভ করতে চান তিনিও। ঠাকুর মথুরবাবুকে বিরত করার অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু মথুরবাবু নাছোড়। শেষে ঠাকুর বাধ্য হয়ে বলেন, ”ঠিক আছে, মা-কে বলব, তিনি যা করার করবেন।” এর কয়েকদিন পরেই সমাধিস্থ হন মথু‌রবাবু। তাঁর চোখ থেকে অবিরল ধারায় ঝরতে থাকে জল। সেই অবস্থায় ঠাকুরকে দেখে তাঁর পা জড়িয়ে ধরেন মথুর। গদগদ কন্ঠে বলেন, ”এ কী করলে ঠাকুর! আমার যে বিষয়কর্ম কিছুতেই মন বসে না আর। আমাকে মুক্তি দাও এ থেকে।” ঠাকুর হেসে বললেন, ”আগেই বলেছিলেম, ভাবসমাধি সকলের সয় না।” মথুরবাবু বুঝলেন কি অদ্ভুর ক্ষমতার অধিকারী ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব ১৮৬১ সাল থেকে ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত মহিলা সাধু এবং ভৈরবী ব্রাহ্মণীর কাছ থেকে তন্ত্র পদ্ধতি শিখেছিলেন। রামকৃষ্ণ তন্ত্রের ৬৪ টি সাধনা পূরণ করেছিল|১৮৬৪ সালে তোতাপুরী নামক জনৈক পরিব্রাজক বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর কাছ থেকে রামকৃষ্ণ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন|পরবর্তীতে বিদায় বেলায় তোতাপুরী আবার তার এই শিষ্যের কাছে দীক্ষা গ্রহন করেন|গুরু শিষ্য পরম্পরার এ এক বিরল ঘটনা|বেশ অল্প সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ১৮৭৯ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নিজের প্রধান শিষ্যদের সঙ্গে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সাক্ষাৎ হয়। এঁদের অনেকেই ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত। কেউ আবার ছিলেন একান্তই নাস্তিক|নিছক কৌতূহলের বশেই তাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখতে এসেছিলেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ এঁদের সকলের মধ্যেই গভীর প্রভাব বিস্তার করে এবং এঁরা সকলেও তাঁর অনুরাগী ভক্তে পরিণত হন। প্রবল যুক্তিবাদী সুরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন,তাকে সমালোচনা করার জন্যে|কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের একনিষ্ঠ ভক্তে পরিণত হন। তাঁর অননুকরণীয় ধর্মপ্রচারের ভঙ্গি অনেক সংশয়বাদী ব্যক্তির মনেও দৃঢ় প্রত্যয়ের উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল|তাই তিনি সব সমালোচনারা উর্ধে এবং ভারতের শ্রেষ্ট গুরুদের একজন|ঠাকুর রামকৃষ্ণের চরনে প্রণাম জানিয়ে গুরু কথার আজকের পর্ব এখানেই শেষ করছি|চলতে থাকবে গুরু কথা|পড়তে থাকুন|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|

গুরু কথা – শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর

আসন্ন গুরু পূর্ণিমা উপলক্ষে শুরু করছি গুরু কথা আজ শুরুতে থাকবে এক মহান আধ্যাত্মিক গুরুর জীবন কাহিনী|গুরু কথার প্রথম পর্বে শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর|অবিভক্ত বাংলার গোপালগঞ্জ জেলার সফলাডাঙ্গা গ্রামে 1812 ক্রিস্টাব্দর 11 মার্চ যশোমন্ত ও অন্নপূর্ণা দেবীর গৃহে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন কলি যুগের এই অন্যতম শ্রেষ্ট মহাপুরুষ|তার পরিবার ছিলো নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব পরিবার|ফলে শৈশব থেকেই শাস্ত্র পাঠ ও ধর্ম আলোচনার প্রতি তার এক গভীর আগ্রহ ও নিষ্ঠা বর্তমান ছিলো|যত বয়স বাড়তে লাগলো শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের মধ্যে এক ঐশরিক শক্তির বিকাশ হতে থাকলো|যথাযত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই তিনি একজন জ্ঞানী শাস্ত্রজ্ঞ ও বৈষ্ণব শাস্ত্রে অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন|মূলত প্রেম-ভক্তির কথা সহজ-সরলভাবে প্রচার করতেন তিনি|পরবর্তীতে তার প্রচলিত সাধন পদ্ধতি মতুয়াবাদ রূপে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে|তিনি মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রান পুরুষ|সারা জীবন তিনি উৎসর্গ করেন মতুয়া আদর্শের প্রচারে এবং প্রসারে|তিনি মনে করতেন ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য সন্ন্যাস নেয়ার প্রয়োজন নেই অন্তরে শ্রদ্ধা ও ভক্তি থাকলে এবং নিষ্ঠা সহকারে ঈশ্বর চিন্তা করলে গৃহীরও ঈশ্বর লাভ সম্ভব|নানা শ্রেণী ও জাতি তে বিভক্ত হিন্দু সমাজ কে তিনি ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন মতুয়াবাদের দ্বারা|তৎকালীন হিন্দু সমাজের অসংখ্য নিপিড়িত, দরিদ্র ও তথা কথিত নিম্ন শ্রেণীর মানুষ দের তিনি পরম স্নেহে বুকে টেনে নিয়েছিলেন এবং তাদের সার্বিক উন্নতি সাধনই ছিলো তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য|আজ দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি মতুয়াদের কাছে শ্রী শ্রী হরিচাঁদ চাঁদ ঠাকুর কলি যুগের শেষ এবং শ্রীহরি-র পূর্ণ অবতার|যথার্থ অর্থেই তিনি পতিতপাবন|শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরে তার জীবনে অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছেন|ঠাকুর হরিচাঁদ তাঁর বাল্য সখাদের নিয়ে মাঠে গরু চড়াতেন এবং সেই সময়ে খেলার ছলে গোপালের ব্রজলীলার ন্যায় লীলা ও কার্যকলাপ প্রকাশ পেতো। বিষধর সাপ ধরে খেলানো, গরুদের ডাকা মাত্র ছুটে আসা,মৃত পশু কে জীবন দান প্রভৃতি লীলা দেখে সাধারন মানুষ বলতো, হরিচাঁদ অলৌকিক ও দৈব্য শক্তির অধিকারী ।পরবর্তীকালেও তিনি অনেক অলৌকিক লীলা করেছেন । হীরমনের রাম-রূপ দর্শন, ঠাকুর হরিচাঁদের সহিত গোস্বামী লোচনের মিলন, গোস্বামী গোলকচাঁদের চতুর্ভূজ রুপ দর্শন, শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের পদে রামচাদের পদ্ম দর্শন, কলমদাস বৈরাগীকে কৃষ্ণ রুপ দেখানো ইত্যাদি আরো অসংখ্য ঘটনা ঠাকুরের অলৌকিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় ।শোনা যায় তার মুখের কথায় কত অপুত্রক পুত্র পেয়েছে , কত মৃত ব্যাক্তি প্রাণ ফিরে পেয়েছে,কত অন্ধ ফিরে পেয়েছে তার দৃষ্টি শক্তি, কত রোগী রোগ মুক্ত পেয়েছে তার হিসেব নেই আজও|যে অলৌকিক ঘটনাগুলি উল্লেখ করলাম সেগুলি শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত গ্রন্হে ঠাকুরের অলৌকিক লীলা প্রসঙ্গে লিপিবদ্ধ আছে|শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ৫ মার্চ ১৮৭৮ সালে ৬৫ বছর বয়সে মর্তলোক ত্যাগ করেন|তার মহা প্রয়ানের পর তার পুত্র শ্রী শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর মতুয়া সমাজের উন্নতি সাধনে ব্রতী হন|আজও বংশ পরম্পরার শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরহরিচাঁদ ঠাকুরের সুযোগ্য বংশধরেরা মতুয়া সমাজ কে নেতৃত্ব দান করে চলেছেন|আজ অসংখ্য মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁরঠাকুরবাড়ি ও মতুয়া ধাম একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে|প্রতি বছর চৈত্র মাসে মতুয়া ধামে মতুয়া মহামেলা বসে যাতে অংশগ্রহণ করেন অগুনতি মানুষ| এই সময়ে ভক্তরা কামনা সাগর’-এ ডুব দিয়ে পুণ্যস্নান করেন|ফিরে আসবো আগামী পর্বে অন্য কোনো গুরুর কথা নিয়ে|আজ এই মহান গুরুর শ্রী চরনে আমার শতকোটি প্রণাম জানিয়ে শেষ করছি আজকের গুরু কথা|চলতে থাকবে গুরু কথা|পড়তে থাকুন|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|

সাধক কথা – শ্রী শ্রী ভবা পাগলা

সামনেই গুরু পূর্ণিমা, আমাদের দেশে অদ্ভুত প্রতিভা সম্পন্ন বহু গুরু ও সাধক সাধিকা জন্মেছেন যাদের সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তী ও লোককথা প্রচলিত আছে, ধারাবাহিক ভাবে এমন কিছু গুরু ও সাধক সাধিকা দের নিয়ে বলবো আগামী কিছুদিন গুরুর কথা|আজ শুরু করবো শ্রী শ্রী ভবা পাগলা কে দিয়ে|ভারতের সাধকদের মধ্যে যারা সঙ্গীত ও আধ্যাত্মিকতা এক সূত্রে গেথে ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ভবেন্দ্র মোহন সেন ওরফে ভবাপাগলা, তিনি ছিলেন পাগল সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা এবং বহু মানুষ তার আদর্শে দীক্ষিত হয়ে তার চরনে নিজেদের জীবন সমর্পন করেছেন|ভবা পাগলার জন্ম আনুমানিক ১৮৯৭ খৃস্টাব্দে বাংলাদেশে, তার পিতার নাম গজেন্দ্র কুমার সাহা, পারিবারিক সূত্রেই ভবা ছিলেন কালী সাধক|পরবর্তীতে দেশ ভাগ হলে ভবাকে চলে আসতে হয় ভারতে, সেখানেও তার সঙ্গে ছিলো একটি কালী মূর্তি,থাকতে শুরু করেন শোভাবাজার অঞ্চলে এক ভক্তের গৃহে, সেখান থেকেই ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়তে থাকে তার গান ও অলৌকিক কীর্তি|শৈশব থেকেই ভবা ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির ও সর্বদা কালী সাধনায় মগ্ন,প্রথা গত শিক্ষা খুব বেশি না থাকলেও আধ্যাত্মিক ভাবে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন ভবা পাগলা|ভবা পাগলার সহজাত প্রতিভা ছিলো গান লেখার ও সুর করার, প্রায় ছেয়াশি হাজার সংগীত রচনা করেছিলেন ও তাতে সুর দিয়েছিলেন,ভবা পাগলা, শ্যামা সংগীত বা ভক্তি গীতিই ছিলো তার সংগীতের প্রধান ভিত্তি|কালী সাধনার মাধ্যম হিসেবে সংগীত কে তিনি সফল ভাবে ব্যবহার করে ছিলেন এবং হয়ে উঠেছিলেন একজন সিদ্ধ পুরুষ|তার গান ” বারে বারে আর আসা হবেনা ” আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে|হালকা পাতলা গড়ন, গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, চিবুকে এক গোছা দাড়ি, এই অতি সাধারণ চেহারার ভবাপাগলার মধ্যে ছিলো অসীম আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও বিশাল অলৌকিক ক্ষমতা, যা বার বার ধরা দিয়েছে তার নানান কর্ম কাণ্ডে, শোনা যায় একবার এক দুরারোগ্য ব্যাধি তে আক্রান্ত ব্যাক্তি কে অলৌকিক ভাবে সুস্থ করে দিয়েছিলেন ভবাপাগলা|আরো এমন বহু অলৌকিক কীর্তি আছে তার সারা জীবনে|নিজের জীবদ্দশায় প্রায় সাতটি কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি|এই মহান সাধক ১৯৮৪ খৃস্টাব্দে দেহ ত্যাগ করেন, আজও তিনি স্মরণীয় তার অলৌকিক কীর্তি ও তার গানের জন্যে|এই মহান কালী সাধককে আমার শ্রদ্ধা ও প্রনাম জানিয়ে শেষ করছি আজকের লেখা|চলতে থাকবে এই ধরবাহিক লেখা লেখি|পড়তে থাকুন|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|

পুরান কথা – গুন্ডিচা মন্দির

রথ যাত্রার সূচনা যেমন হয় স্নান যাত্রা দিয়ে তেমনই সমাপ্তি হয় উল্টো রথ দিয়ে আর এই উল্টো রথ প্রসঙ্গে বার বার আলোচিত হয় গুন্ডিচা ম্পন্দিরের কথা|উল্টো রথে নয় দিন পর গুন্ডিচা মন্দির থেকে নিজ মন্দিরে ফিরে আসেন জগন্নাথ দেব|গুন্ডিচা মন্দির ভ্রমণকেই আবার মাসির বাড়ি যাওয়া মনে করেন অনেকে। গুণ্ডিচা মন্দির জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি বা বাগানবাড়ি নামেও পরিচিত। মন্দিরটি একটি স্বর্গীয় বাগানের মাঝে অবস্থিত। শ্রীজগন্নাথদেবের মূল মন্দির তথা “শ্রীমন্দির”-এর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে গুন্ডিচা মন্দির।বছরের অন্যান্য সময়ে মন্দিরটি প্রায় শূণ্য থাকে। রথযাত্রার ঠিক একদিন আগে থেকে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার থাকার উপযুক্ত করে তোলার জন্য ধর্মীয়ভাবে গুণ্ডিচা মন্দির সংস্কার করা হয় এবং আষাঢ় মাসের রথযাত্রার সাতদিন যাবৎ এই গুণ্ডিচা মন্দিরেই জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রার আরাধনা করা হয়।আসলে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রীছিলেন গুণ্ডিচা।রাণী গুণ্ডিচার নামেই সংশ্লিষ্ট মন্দিরটি নির্মিত যা নিয়ে প্রচলিত রয়েছে একটি পৌরাণিক ঘটনা|দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা জগন্নাথ মূর্তি তৈরি করার সময় রাণী গুণ্ডিচা বন্ধ দরজার বাইরে থেকে নিষেধ অমান্য করে উঁকি মারেন এবং জগন্নাথের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে তার জন্য একটি পৃথক মন্দির তৈরী করবেন ঠিক করেন|পরবর্তীতে জগন্নাথদেব তার জন্য তৈরি মন্দির দেখে সন্তুষ্ট হন ও রানী গুন্ডিচার ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে রাণী গুণ্ডিচাকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি তার বাড়ীতে আসবেন। যেটি বর্তমানে গুণ্ডিচা মন্দির নামে খ্যাত।গুন্ডিচা মন্দির ও জগন্নাথ দেবের সাতদিন এই মন্দিরে থাকা নিয়ে একটি শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা আছে|অনেকে মনে করেন জগন্নাথ দেব গুণ্ডিচা মন্দিরে সাত দিন থাকার সময়ে তার স্ত্রী দেবী লক্ষ্মীকে মূল মন্দিরের সংগ্রহকক্ষে বন্দিনী করে রেখে আসেন এবং গুণ্ডিচা মন্দিরে তিনি তার প্রিয় গোপীগণের সাথে সময় অতিবাহিত করেন এটি বৃন্দাবনে কৃষ্ণের রাসলীলার মতো একটি বিশেষ লীলা|অন্য একটি ব্যাখ্যা অনুসারে “গুণ্ডিচা” ছিলেন স্থানীয় দেবী লৌকিক দেবী যিনি মা শীতলার ন্যায় গুটিবসন্ত রোগ নিরামক। ওড়িয়া ভাষাতে “গুণ্ডি” শব্দটির অর্থ গুটিবসন্ত, যা বাংলা “গুটি” শব্দটি থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। এবং বাংলার গুটিবসন্ত নিরাময়ের দেবী “গুটিকা ঠাকুরাণী” এবং ওড়িয়া “গুণ্ডিচা”কে একই ব্যাক্তিচৈতন্য মহাপ্রভু একবার রথযাত্রার আগের দিন গুণ্ডিচা মন্দির পরিষ্কার করার দায়িত্ব নেন। এই রীতিটি বর্তমানেও রথযাত্রার আগের দিন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ পালন করে থাকেন।চলতে থাকবে পৌরাণিক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা ও ব্যাখ্যা|গুরু পূর্ণিমা উপলক্ষে ভারতের আধ্যাত্মিক গুরু ও তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনা নিয়ে ফিরে আসবো|পড়তে থাকুন|ধন্যবাদ|

পুরান কথা – সুভদ্রার আসল পরিচয়

বছরের এই সময়ে রথ যাত্রা উপলক্ষে শুধু জগন্নাথ নন দুই দাদা জগন্নাথ ও বলরামের সঙ্গে রথে চড়ে মাসির বাড়ি যান তাদের বোন সুভদ্রাও।কিন্তু আসলে কে এই সুভদ্রা ও কি তার আসল পরিচয় আজকের পর্বে সেই কথাই বলবো|সুভদ্রা মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আবার সুভদ্রার উল্লেখ বারবার পুরাণেও পাওয়া যায়। বীরযোদ্ধা অভিমন্যুর মা তিনি। রথযাত্রার আগে মহাভারত অনুসারে কৃষ্ণ ও বলরামের ছোট বোন সুভদ্রাকে বিয়ে করেছিলেন তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন। সুভদ্রা ও অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু চক্রব্যুহ ভেদ করে সপ্তরথীর সঙ্গে একা বীরের মতো যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। তবে শুধু কৃষ্ণ ও বলরামের বোন, অর্জুনের স্ত্রী এবং অভিমন্যুর মা এই পরিচয়ই সুভদ্রার জন্য যথেষ্ট নয় তার আরো একটি পরিচয় আছে|সুভদ্রা আসলে সেই যোগমায়া, যাঁকে তাঁর জন্মের রাতেই মায়ের কোল থেকে সরিয়ে এনে তুলে দেওয়া হয়েছিল কংসের হাতে। সদ্যোজাত কৃষ্ণকে রক্ষা করতে তাকে ঘাতকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন কৃষ্ণর পিতা বসুদেব|শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে একই সময়ে নন্দ ও যশোদার ঘরে জন্মেছিলেন যোগমায়া|তিনি স্বয়ং দেবী পার্বতী। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির সেই রাতে কৃষ্ণকে কংসের কারাগার থেকে সরিয়ে ফেলতে গোকূলে যান বসুদেব। সেখানে অচেতন যশোদার পাশ থেকে সদ্যজাত যোগমায়াকে সরিয়ে সেখানে কৃষ্ণকে রেখে আসেন তিনি। যোগমায়াকে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে এসে দেবকীর পাশে শুইয়ে দেন।পরের ঘটনা কম বেশি সবাই জানেন কংস এসে যোগমায়াকে নিধন করতে উদ্যত হলে তাঁর হাত ছাড়িয়ে আকাশে মিলিয়ে যান তিনি। যাওয়ার আগে কংসকে এই বলে সতর্ক করে দিয়ে যান, ‘তোমারে বধিবে যে, গোকূলে বাড়িছে সে।’পরবর্তীতে তাই হয়েছিলো কৃষ্ণের হাতে পরাজিত ও নিহত হন কংস|পার্বতীর অংশ যোগমায়াই পরে বসুদেব ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী রোহিনীর সন্তান হয়ে জন্ম নেন। তখন তাঁর নাম হয় সুভদ্রা, কৃষ্ণ ও বলরামের আদরের বোন। পুরীতে কৃষ্ণ জগন্নাথ রূপে পূজিত তাঁর সঙ্গে থাকেন দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রা|আগামী পর্বে আরো একটি রথ যাত্রা বিষয়ক পর্ব নিয়ে ফিরে আসবো|পড়তে থাকুন|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|

মাহেশের রথের অলৌকিক ঘটনা

আজ বলবো বিখ্যাত মাহেশ এর রথের কথা|পুরীর পরেই শ্রীচৈতন্য ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের স্মৃতি বিজড়িত দ্বিতীয় বৃহত্তম ও প্রাচীন রথোৎসব হয় শ্রীরামপুরের এই মাহেশেই।রাধারানী’ উপন্যাসে মাহেশের রথের কথা লিখেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।কবে কিভাবে শুরু হয়েছিলো এই প্রাচীন রথ যাত্রা তা সঠিক ভাবে জানা না গেলেও কিছু কিছু ইতিহাস জানা যায়|শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম পার্ষদ কলকাতার শ্যামবাজার নিবাসী বলরাম বসুর পিতামহ ছিলেন কৃষ্ণরাম বসু। তিনি একটি সুদৃশ্য উচ্চ কাঠের রথ করিয়ে দেন মাহেশ রথ যাত্রার উদ্দেশ্যে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে। কালের নিয়মে এটি নষ্ট হয়ে যায়। কৃষ্ণরাম বসুর পুত্র গুরুপ্রসাদ বসু। তিনি আবার রথটি নির্মান করে দিলেন ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে। এবার রথটি অগ্নিদগ্ধ হল। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় একটি নতুন রথ নির্মান করিয়ে দিলেন কালাচাঁদ বসু। এক সময় ওই রথটিতে জনৈক ব্যাক্তি মারা যান গলায় দড়ি দিয়ে। ফলে অপবিত্র জ্ঞানে পরিত্যক্ত হল সেটি। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে আবার একটি রথ তৈরি করিয়ে দিলেন বিশ্বম্ভর বসু। এমনই কপাল জগন্নাথের, সেটিও একদিন অগ্নিদাহে ভস্মীভূত হল। এরপর আর কাঠের নয়, তৈরি হল লোহার রথ। বর্তমানে সেই রথই চলছে যা 1885 সালে নির্মিত হয়েছিলো|মাহেশের রথ নিয়ে একটি অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ আছে|শোনা যায় একবার রথ যাত্রার সময়ে স্থানীয় এক মিষ্টির দোকানে হাজির হলো এক বালক|সে জিলিপি খেতে চাইলো কিন্তু তার কাছে অর্থ নেই|বালক তার হাতের বালা খুলে তার বিনিময়ে জিলিপি ক্রয় করতে চাইলে দোকানদার প্রথমে রাজি হলোনা|পরে বালকের জেদের কাছে হার মানলেন তিনি এবং বালা নিয়ে জিলিপি দিলেন|বালক জিলিপি নিয়ে চলে গেলো|রথ যাত্রার সময় প্রধান পুরোহিত লক্ষ্য করলেন প্রভু জগন্নাথ এর হাতে একটি বালা নেই|চিন্তায় পড়লেন তিনি|অনেক ভেবেও বুঝতে পারলেন না কোথায় গেলো প্রভুর হাতের বালা|রাতে স্বয়ং জগন্নাথ তার স্বপ্নে দেখা দিলেন এবং বললে যে তিনি নিজে বালা জোড়া মিষ্টির দোকানে দিয়ে তার বিনিময়ে জিলিপি খেয়েছেন|পরদিন সকালে পুরোহিত লোক জন নিয়ে সেই মিষ্টির দোকানে গেলেন এবং বালা জোড়া উদ্ধার করলেন|সবাই অবাক হয়েছিলো প্রভু জগন্নাথ এর অদ্ভুত লীলার কথা জানতে পেরে|আবার ফিরে আসবো আগামী পর্বে প্রভু জগন্নাথ ও তার রথ যাত্রা নিয়ে আলোচনায়|পড়তে থাকুন|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|

জয় জগন্নাথ – নানাবেশে জগন্নাথ দেব

নানা সময়ে নানা বেশে সাজেন জগতের নাথ আজ সেই বেশগুলির কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করবো|প্রাচীন গ্রন্থ মাদলা পাঞ্জিতে উল্লেখ আছে ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে ওড়িশার গজপতি রাজা কপিলেন্দ্র দেব দাক্ষিণাত্যের এক রাজার বিরুদ্ধে ভীষণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর কপিলেন্দ্র যুদ্ধে জয়লাভ করেন। লুঠে আনেন ষোলটি হাতির পিঠ বোঝাই করে সহস্র মণ সোনা। সমস্ত সোনা রাজা কপিলেন্দ্র জগন্নাথদেবের মন্দিরের ভাণ্ডারে পাঠিয়ে দিলেন এবং জগন্নাথদেবকে তিনি ওড়িশার প্রকৃত রাজা বলে স্বীকার করলেন ও নিজেকে তাঁর অনুগত সেবক বলে ঘোষণা করলেন|অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই ক্ষমতা হস্তান্তর সর্বসাধারণের সম্মুখে উদযাপনের জন্য তিনি এই সময় জগন্নাথের ‘রাজবেশ’-এর প্রবর্তন করলেন। সাধারণের কাছে এই ‘বেশ’ আর একটি নাম পেল, তা হল, ‘বড়া তাধাও বেশ’।জগন্নাথদেবকে পুরীতে সাধারণ দিনগুলিতে যে বেশে দেখা যায়, সেই বেশ পরিচিত সাদা বেশ নামে। এরপর রাতে যে বেশে জগন্নাথ, বলরাম, শুভদ্রাকে রাখা হয় তার নাম বড়সিংহের বেশ। চন্দনলাগি বেশ শুরু হয় বৈশাখ জৈষ্ঠের সময়, এই সময় ভগবানকে চন্দনের প্রলেপে রাখা হয় এবং ৪২ দিন ধরে চলে এই উৎসব।জগন্নাথদেবের আরকেটি বিখ্যাত বেশ হলো হাতি বেশ|হাতিবেশ রথযাত্রার আগে স্নান যাত্রার সময় দেখা যায় । এই সময়ে গণপতির বেশে জগন্নাথকে সাজানো হয় বলে নাম ‘হাতি বেশ’। গণেশের বেশে স্নানযাত্রার পর উঠে আসেন জগন্নাথ।হাতি বেশের নেপথ্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা আছে|বহু শতক আগে পুরীর রাজার রাজদরবারে এসেছিলেন পণ্ডিত গণেশ ভট্ট। রাজা তাঁকে জহগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা দেখবার জন্য আহ্বান জানান। তবে তা দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিলনা গনেশ ভট্টর। কারণ তাঁর আরাধনার দেবতা গণপতি স্বয়ং। কিন্তু স্নানযাত্রায় গিয়ে গণেশ ভট্ট আবিষ্কার করেন, যে যে বিষ্ণুর অবতার জগন্নাথের স্নান তিনি দেখছেন, তাঁর রূপ যেন হুবহু গণেশ! সমস্ত ঈশ্বর তাঁর কাছে একই মনে হতে লাগল। আর সেই ঘটনার পর থেকেই স্নান যাত্রায় জগন্নাথের বেশ হয় হাতিবেশ।পুরীর জগন্নাদেবের থের বিভিন্ন বেশের মধ্যে অন্যতম হল কালিয়াদলন বেশ। ভাদ্র একাদশীর দিন পুরীর জগন্নাথকে সাজানো হয় এই বিশেষ বেশে। যেভাবে শ্রীকৃষ্ণ দুর্দমনীয় রাক্ষস কালিয়াকে হত্যা করেছিলেন, সেই বেশেই এদিন সাজানো হয় জগন্নাথকে।আশ্বিনে যে নয়নাভিরাম বেশকর্ম শ্রীমন্দিরে অনুষ্ঠিত হয়, তার নাম ‘রাধা-দামোদর বেশ’।আশ্বিনের শুক্ল পক্ষের একাদশী তিথিতে শুরু হয়ে এই ‘রাধা-দামোদর বেশ’ কার্তিকের শুক্ল দশমী অবধি নিত্যই অনুষ্ঠিত হয়।জগন্নাথদেবের আরো একটি বেশ হলো পদ্মবেশ|মাঘ ও বসন্তের শনিবার ও বুধবার জগন্নাথ ধারণ করেন পদ্মবেশ।আগামী দিনেও ফিরে আসবো প্রভু জগন্নাথদেবের মহিমা বর্ণনা করতে| আলোচনা চলবে উল্টো রথ অবধি|পড়তে থাকুন|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|

পুরান কথা – পুরীধাম ও মহাপ্রভু

পুরীধাম ও বিখ্যাত রথ যাত্রার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যর নাম এবং তার হাত ধরেই বাংলা ও পরবর্তীতে দেশের বাইরেও ছড়িয়েছে রথ যাত্রার মহিমা|সন্ন্যাস নেওয়ার অল্প দিন পরে, ১৫১০ সালে পুরীতে প্রথম বার পৌঁছে মহাপ্রভু ভাবে বিভোর হয়ে জড়িয়ে ধরতে গিয়েছিলেন দারুবিগ্রহ। জীবনের ২৪টা বছর শ্রীচৈতন্য পুরীতেই ব্যয় করলেন এই ২৪ বছরের মধ্যে প্রথম ৬ বছর অবশ্য তিনি বৃন্দাবনসহ উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারত সফরের জন্য পুরীকেই কেন্দ্র করেছিলেন। সেখান থেকেই নানা দিকে যাতায়াত করেছিলেন। মায়ের সঙ্গে শেষ বার দেখা করে আসার পর পুরীতে টানা ১৮ বছর বাস করেছেন, ১৫৩৩ সালে সেখানেই রহস্যজনক ভাবে বৈকুন্ঠে লীন হয়ে গেলেন।কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর ‘চৈতন্যচরিতামৃত‘-র মধ্যলীলা পর্যায়ে জানিয়েছেন, রাজা প্রতাপ রুদ্রদেব চৈতন্য ও তাঁর সঙ্গীদের রথযাত্রায় অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়েছিলেন।আরো বর্ণনা আছে যে বিশাল দারুমূর্তিগুলি কী ভাবে রেশমি দড়িতে বেঁধে সেবকরা মন্দিরের বাইরে নিয়ে আসছেন, পুরু মাদুরের উপর দিয়ে সেগুলি রথে নিয়ে তুলছেন, সেই বর্ণনাও চরিতামৃতে আছে। রাজা নিজে সোনার হাতলওয়ালা ঝাঁটা নিয়ে জগন্নাথদেবের পথ পরিষ্কার করেন, সারা রাস্তায় সুগন্ধি চন্দনজল ছেটানো দেখে মহাপ্রভুও চমৎকৃত হয়েছিলেন।চৈতন্য বারংবার বলেছেন, পুরীর এই নীলমাধবই স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, তিনি তাঁরই আরাধনা করেন এবং তিনি শুধু শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের ভক্ত, কোনও জাত বা সম্প্রদায়ে বিশ্বাসী নন।উল্লেখ যোগ্য বিষয় হলো পুরীবাসে চৈতন্যের প্রধান শিষ্যরা, যেমন রামানন্দ, শ্যামানন্দ, বলদেব বিদ্যাভূষণ কেউই ব্রাহ্মণ নন। পুরীর তৎকালীন ব্রাহ্মণ পান্ডা ও পুরোহিতেরা সারা বছর এই শূদ্রদের জগন্নাথ দর্শনের বিপক্ষে। শবরদের জগন্নাথ তখন ব্রাহ্মণদের অধিকারে মন্দিরের পুরোহিতেরা বিধান দিলেন, জগন্নাথদেব বছরে এক বারই মানুষের দরবারে বেরোতে পারবেন আর সেই দিনটা হলো রথ যাত্রা|খ্যাতির শীর্ষে থাকা কালীন রহস্যজনক ভাবে পুরী থেকে মহাপ্রভু হারিয়ে গেলেন। অচ্যুতানন্দ দাস, দিনকর দাস, ঈশ্বরদাসের মতো চৈতণ্য জীবনীকার ও টীকাকারেরা বারংবার বলেছেন, নীলমাধব বিগ্রহে মিশে গিয়েছে তাঁর শরীর, কিন্তু সে নিয়ে হরেক সন্দেহ আর বিতর্ক কারন বিভিন্ন ঠিকাকার তার অন্তর্ধান নিয়ে আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা করেছেন|কোথাও বলার হয়েছে রথ যাত্রার সময়ে পায়ে আঘাত লেগে তার মৃত্যু হয়েছে আবার কেউ বলেছেন সমুদ্রে তার জলসমাধি হয়েছে|অনেকেই মনে করেন মহাপ্রভুর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পেছনে অন্য কোনো কারন আছে হয়তো জাতি ভেদ ও বর্ণ ভেদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া অন্য দিকে তার শিষ্য হয়ে পুরীর রাজার যুদ্ধ ও রাজনীতি থেকে দূরে থাকা অনেকেরই পছন্দ হয়নি তাই মহাপ্রভুর বিরুদ্ধে চক্রান্ত হয়েছিলো|সব থেকে বড়ো প্রশ্ন তার যদি স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে থাকে তার কোনো সমাধি স্থান নেই কেনো? আর যদি জগন্নাথ মূর্তিতে তিনি বিলীন হয়ে যাবেন তবে তার সমসাময়িক টিকাকারদের মধ্যে এতো শ্ববিরোধী মন্তব্য কেনো? চৈতণ্য অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে চলেছে গবেষণা একাধিক উপন্যাস ও লেখা হয়েছে|তবে সব প্রশ্ন ও দ্বিধা দূর হয় যদি চৈতণ্যদেবকে অবতার রূপে মেনে নেয়া হয়ে আর যদি তাকে সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখা হয়ে তবে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়|যাই হোক বিতর্ক নয় তার ভক্তি ও আদর্শ তাকে অমর করে রাখবে সারা বিশ্বে|পুরী ও রথ যাত্ৰা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকবে উল্টো রথ অবধি |পড়তে থাকুন|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|

পুরান কথা – ছাপ্পান ভোগ

আমাদের সনাতন ধর্মে পবিত্র চার ধাম হল- বদ্রীনাথ ধাম,দ্বারিকা ধাম,পুরী ধাম এবং রামেশ্বরম। প্রথমে হিমালয়ের শিখরে অবস্থিত বদ্রীনাথ ধামে স্নান করেন,তারপর গুজরাটের দ্বারিকা ধামে গিয়ে বস্ত্র পরিধান করেন, ওড়িশার পুরী ধামে ভোজন করেন আর সবশেষে রামেশ্বরমে গিয়ে বিশ্রাম নেন।পুরী ধামে যেখানে তিনি ভোজন করেন সেখানে ভোগের কোনও চমক থাকবে না এটা কখনও হয়। সেখানেই তাঁকে ছাপ্পান্ন ভোগ দেওয়া হয়। আজ আসুন জেনে নিই কী এই ছাপ্পান্ন ভোগ| পুরাণ মতে, যশোদা বালক কৃষ্ণকে আট প্রহর খেতে দিতেন। যখন ইন্দ্রের রোষে পড়ে মহাপ্রলয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সময় প্রাণীদের রক্ষা করতে নিজের কনিষ্ঠ আঙুলে গোবর্ধন পাহাড় তুলে নিয়েছিলেন তিনি। সাতদিন ওইভাবেই তিনি ছিলেন। খাবার ও জল কোনও কিছুই মুখে দেননি। প্রলয় বন্ধ হওয়ার পর সেই পাহাড় নামিয়ে রেখেছিলেন। এদিকে যে ছেলে দিনে আটবার খাবার খেত তাকে টানা সাতদিন অনাহারে থাকতে দেখে কেঁদে উঠেছিল যশোদার মন। তখন ব্রজবাসী-সহ যশোদা সাতদিন ও আট প্রহরের হিসেবে কৃষ্ণের জন্য ৫৬টি পদ পরিবেশন করেছিলেন। আর সেই থেকেই নারায়ণের ছাপ্পান্ন ভোগ চলে আসছে।পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম রান্নাঘর। সেখানে বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না হয় ছাপ্পান ভোগ|জগন্নাথের ভোগে মূলত দুই ধরনের খাবার দেওয়া হয়। ভাত, ডাল, তরকারি, খিচুড়ি জাতীয় রান্না করা খাবার থাকে। আর থাকে খাজা, গজা, খই, মুড়কি জাতীয় শুকনো খাবার। মূলত ফুটন্ত জলে সবজি এবং মশলা দিয়ে চলতে থাকে মহাপ্রভুর রান্না। মশলা বলতে শুধুমাত্র নুন এবং হলুদের ব্যবহার। পেঁপে, আলু, টমেটো, কাঁচা লঙ্কা জাতীয় সবজি জগন্নাথের রান্নায় ব্যবহার করা হয় না। বাল্যভোগে জগন্নাথদেবকে দেওয়া হয় খই, চিঁড়ে, বাতাসা, মাখন, মিছরি, কলা, দই এবং নারকেল কোরা। এরপর দেওয়া হয় রাজা ভোগ। এই তালিকায় থাকে মিষ্টি চালের খিচুড়ি, ডাল, তরকারি, ভাজা এবং পিঠেপুলি। দুপুরের ভোগ মূলত অন্নভোগ। সেখানে থাকে ভাত, ডাল, শুক্তো, তরকারি ও পরমাণ্ণ। এছাড়াও থাকে ক্ষীর ও মালপোয়া। সন্ধেবেলায় দেওয়া হয় লেবু, দই দিয়ে মাখা পান্তাভাত। সঙ্গে খাজা, গজা এবং নানা ধরনের মিষ্টি। রাত ১১টার সময় ভাজা ও ক্ষীর দেওয়া হয় তাঁকে। আর মধ্যরাতে ডাবের জল খেয়ে শুতে যান ভগবান। এভাবেই তাঁক ছাপ্পান্ন ভোগ অর্পণ করা হয়ে থাকে।রথ যাত্রা উপলক্ষে চলতে থাকবে প্রভু জগন্নাথ ও তার নানা লীলা নিয়ে আলোচনা|পড়তে থাকুন|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|

পুরান কথা – বলরাম এর প্রকৃত পরিচয়

রথ যাত্রা মূলত জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মাসির বাড়ি যাওয়ার অনুষ্ঠান। শ্রীকৃষ্ণের অন্য একটি রূপ জগন্নাথের কথা তো আমরা সবাই জানি যিনি এই উৎসবের কেন্দ্রে থাকেন এবং মূল আকর্ষন|বলরাম ও সুভদ্রা ও আধ্যাত্মিক ভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ|তাই আজকের পর্বে কৃষ্ণের বড় ভাই বলরামকে নিয়ে লিখবো|কৃষ্ণের সত্‍ মা রোহিণীর গর্ভে জন্ম হয় বলরামের। তিনি ছিলেন আসলে কংসের কারাগারে বন্দি বসুদেব ও দেবকীর সপ্তম গর্ভের সন্তান। কংসের হাত থেকে তাঁকে বাঁচানোর জন্য শ্রীহরির নির্দেশে সপ্তম গর্ভের ভ্রুণ রোহণীর গর্ভে প্রতিস্থাপিত করা হয়। কংসকে জানানো হয় যে দেবকী মৃত সন্তান প্রসব করেছেন।শক্তি ও আধ্যাত্মিকতার মিলন হয়েছে বলে তাঁর নাম বলরাম। অনেকের মতে বিষ্ণুর এক অবতার রামের ছোট ভাই লক্ষ্মণ দ্বাপর যুগে তাঁর বড় ভাই বলরাম হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন।মহাভারতে বলরামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলদেব, বলভদ্র বা হলায়ুধ নামেও পরিচিত। বৈষ্ণবরা বলরামকে বিষ্ণুর অবতার-জ্ঞানে পুজো করেন। ভাগবত পুরাণেও তাঁর নাম রয়েছে। বিষ্ণুর শয্যারূপী শেষনাগের একটি রূপেও তাকে দেখা হয় কোথাও কোথাও|আগামী দিনে সুভদ্রাকে নিয়েও আলাদা করে একটি পর্বে লিখবো|রথ সংক্রান্ত নানা কথা চলতে থাকবে ধারাবাহিক ভাবে উল্টো রথ পয্যন্ত|পড়তে থাকুন|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|