ভারত আধ্যাত্মিকতার দেশ, সনাতন সংস্কৃতির দেশ আর এই দেশের মহান আধ্যাত্মিক পরম্পরাকে যুগ যুগ ধরে বহন করে নিয়ে চলেছে ভারতের অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন সাধু সন্ত বা যোগী পুরুষরা|হাজার হাজার বছরের শাস্ত্র সম্মত জ্ঞান কে সম্বল করে তারা এক আধ্যাত্মিক বিপ্লব ঘটিয়েছেন যা আজও পাশ্চাত্য জগতের কাছে এক বিস্ময়| হিমালয়ের বরফাবৃত গুহা থেকে শুরু করে বেনারসের গঙ্গার ঘাট, সর্বত্র চোখে পড়ে সাধু সন্ন্যাসী,তবে কেউ কেউ আছেন যাদের জীবন ও সাধনা আজ গবেষণা ও চর্চার বিষয়,সারা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে তাদের অনুগামী, ভক্ত, শিষ্য|কিন্তু দুর্ভাগ্যর বিষয় দেশের মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই তাদের খবর রাখেন না সেই ভাবে,বর্তমান প্রজন্ম তাদের নামের সাথে পরিচিত হলেও তাদের সঠিক মূল্যায়ন হয়ে ওঠেনি এখনো|এই বিশেষ ধারাবাহিক লেখনীর একেকটা পর্বে আমি বলবো এক এক জন মহান সাধকের কথা,তুলে আনবো তাদের জীবনের নানা অজানা কথা|আজ প্রথম পর্বে ভারতের অন্যতম রহস্যময় ও মহানতম যোগী পুরুষ ” মহাবতার বাবাজি “
সাধনার জোরে অমরত্ত্ব লাভ করেছেন এমন নজির খুব কমই আছে জগতে, মহাবতার বাবাজি এমনই একজন সিদ্ধ যোগী|তাকে বলা হয় গুরুদের গুরু বা জগৎ গুরু|ক্রিয়া যোগের তিনি প্রান পুরুষ|ধ্যান, আধ্যাত্মিকতা ও আসন কে তিনি এক সূত্রে গেথেছেন কয়েক হাজার বছর আগে|পরবর্তীতে তার পথ অনুসরণ করে আধ্যাত্মিক পথে এগিয়েছেন তার সুযোগ্য শিষ্যরা যার মধ্যে শ্যামাচরণ লাহিড়ী, যুক্তেশ্বর গিরি, পরমহংস যোগানন্দ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য|
মহাবতার বাবাজি কে নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য গল্প, কিংবদন্তি ও রহস্য|কেউ কেউ মনে করেন ক্রিয়া যোগের মাধ্যমে তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন|কঠোর সাধনার মাধ্যমে তিনি সময় কে জয় করে জন্ম মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করেছেন এবং আশ্চর্য জনক ভাবে হাজার হাজার বছর ধরে স্বশরীরে বিরাজ করছেন এই পৃথিবীতে| একাধিক বার তার সাক্ষাৎ লাভ করে ধন্য হয়েছেন একাধিক সাধক|শোনা যায় হিমালয়ের এক দুর্গম স্থানে শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয় কে দীক্ষা দিয়েছিলেন স্বয়ং মহাবতার বাবাজি|পরমহংস যোগানন্দ তার ” অটো বায়োগ্রাফি অফ এ যোগী ” বইয়ে তার মহাবতার বাবাজির দর্শনের কথা বলেছেন|একাধিক বার সামনে এসেছে হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলে তার রহস্যময় উপস্থিতির কথা|
বাবাজির জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না তবে মনে করা হয় তামিলনাড়ুর কোনো গ্রামে তার জন্ম হয়েছিলো, তার সঠিক বয়স নিয়েও মতপার্থক্য রয়েছে|কারুর মতে 5000 তো কারুর মতে 2000 বছরের কিছু বেশি তার বয়স|যোগ বলে তিনি তারুণ্য কে ধরে রেখেছেন তাই দেখলে মনে হয় এক যুবক|বাবাজির ইচ্ছে না থাকলে তাকে দর্শন করা যায়না|তিনি ঝড়ের গতিতে প্রকট হন আবার মহাশূন্যে মিলিয়ে যান|একটি প্রচলিত বিশ্বাস মতে হিমালয়ের কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে রয়েছে জ্ঞানগঞ্জ নামে এক রহস্যময় মঠ, যেখানে সিদ্ধ পুরুষ ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারেনা, বাবাজির সেই মঠেই থাকেন, শুধু তাই নয় তিনি জ্ঞান গঞ্জের আচার্য|সুক্ষ দেহে তিনি সর্বত্র বিচরণ করেন আবার প্রয়োজন হলে নিজ দেহ ধারন করে প্রকট হন, তবে তার দর্শন করে অতি দুর্লভ ঘটনা, এবং সৌভাগ্যর হাতে গোনা কয়েকজন আজ অবধি তার দর্শন করতে পেরেছেন|
কিছু রহস্য হয়তো আজীবন রহস্যই থাকবে|তবে আমিও চেষ্টা চালিয়ে যাবো এরকম রহস্যময় সাধক দের এক এক করে আপনাদের সামনে আনতে, দেখা হবে পরের পর্বে অন্য কোনো সাধককে নিয়ে আলোচনা হবে|মনে রাখবেন আমরা এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি, সামনেই ঝুলন ও রাখি পূর্নিমা, এই সময় কোনো প্রকার জ্যোতিষ সংক্রান্ত কাজ বা গ্রহ দোষ খণ্ডন অনেক বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে জীবনে, তাই আর দেরি করবেন না|প্রয়োজন মনে কোরলে অবশ্যই যোগাযোগ করবেন উল্লেখিত নাম্বারে আর সরাসরি কথা বলবেন আমার সাথে|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ
ভারতের সাধক – মহাবতার বাবাজি
শক্তি পীঠ – জ্বালা মুখী
বহুদিন পর আজ একটি শক্তিপীঠ নিয়ে বলবো|আজকের পর্বে আলোচনা করবো শক্তিপীঠ জ্বালামুখী নিয়ে|এই পীঠটি বিশেষ, কারন বহু ঐতিহাসিক, অলৌকিক ও আধ্যাত্মিক বিস্ময় জড়িয়ে আছে এই পীঠের সাথে|মানুষের মধ্যে এই পীঠ নিয়ে কৌতূহলের কোনো সীমা নেই, তার পাশাপাশি আছে অটুট বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও ভক্তি|আসুন শুরু করা যাক আজকের শক্তিপীঠ পর্ব জ্বালামুখী|
তন্ত্র শাস্ত্রে এই পীঠ সম্বন্ধে বলা হয় – “জ্বালামুখ্যাঁ তথা জিহ্বা দেব উন্মত্ত ভৈরবঃ অম্বিকাসিদ্ধিনান্মী”
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যেও এই পীঠের উল্লেখ আছে, সেখানে বলা হচ্ছে-
“জ্বালমুখে জিহ্বা তাহে অগ্নি অনুভব
দেবী অম্বিকা নাম উন্মত্ত ভৈরব”
ভারতের হিমাচল প্রদেশের কাংড়া উপত্যকায় অবস্থিত জ্বালা মুখী শক্তি পীঠ পুরান মতে এখানেই কালীধর পাহাড়ে কোথাও দেবী সতীর জিহ্বা পতিত হয়েছিল। দেবতাদের তেজ সম্পন্ন হয়ে একটি অগ্নিশিখা সর্বদা নাকি জ্বলছে । রাজা ভূমিচন্দ্র সেই স্থানের অনেক সন্ধান করেন কিন্তু খুঁজে না পেয়ে নগরকোটের সামনে একটি দেবীর মন্দির নির্মাণ করেন পরে একদিন রাজা এক গোয়ালার কাছে দেবীর অগ্নি শিখার কথা শুনলেন এবং সেই স্থান খুঁজে পেয়ে সেখানেই দেবীর মন্দির নির্মাণ করলেন ।মহাভারত কালে নাকি পঞ্চপাণ্ডব এই স্থার্ন মন্দির নির্মাণ করেছিলেন এমনটাও শোনা যায়|বহু কিংবদন্তী ও অলৌকিক মহিমা প্রচারিত আছে এই শক্তি পীঠ ঘিরে|
এই পীঠের দেবী হলেন- সিদ্ধিদা আর ভৈরব হলেন উন্মত্ত । আবার কারোর মতে এই পীঠের দেবী হলেন অম্বিকা, ভৈরব হলেন উন্মত্ত । আবার কিছু পণ্ডিত দের মত দেবী হলেন অম্বিকা, ভৈরব হলেন বটুকেশ্বর|মন্দিরের কাছেই এক পাহাড়ে ভৈরব বিরাজমান |মায়ের মন্দিরে কোনো বিগ্রহ নেই|এক জ্বলন্ত দিব্য অগ্নি শিখাকে দেবী রূপে পূজা করা হয়|মায়ের মন্দিরের উত্তর দিকের দেওয়ালের মাঝে মায়ের মূল জ্যোতি বা আগুনের শিখা বিরাজমানা|
বলা হয় এই আগুনের শিখাই হলেন মা জগদম্বা সিদ্ধিদা, অম্বিকা,জ্বালামুখী| ভক্তেরা যে যে নামে ডাকবে মা তাদের কে সেই রূপেই কৃপা করবেন । এই আগুনের শিখা অনবরত জ্বলছে| কোনদিন নেভেনি |
বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই শক্তি পীঠ| মুঘল সম্রাট আকবর, দেবীর মহিমা প্রত্যক্ষ করতে একবার এই পীঠে আসেন। আবুল ফজলের রচিত ‘আইন- ই – আকবরি’ তেও এই পীঠের কথা উল্লেখ আছে । প্রথমে আকবর, মা জুয়ালার ক্ষমতাকে বিশ্বাস করতেন না পরে দেবীর অলৌকিক ক্ষমতার প্রমান পেয়ে আকবর , দেবীর মহিমা স্বীকার করেন এবং দেবীর মন্দিরে একটি সোনার ছাতা প্রদান করেন|একবার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরোজ শাহ জ্বালা দেবীর মন্দির লুঠপাঠ ও ধ্বংস করার জন্য রওনা হয়েছিলেন কিন্তু পথে এক জায়গা তে তারা মৌমাছিল আক্রমণের শিকার হলেন| কাতারে কাতারে ফিরোজের সেনারা মৌমাছির বিষাক্ত হূলে মারা পড়তে লাগলো|অবশেষে ফিরোজ শাহ পরাজয় স্বীকার করে পিছু; হটলেন|মনে করা হয় দেবীর ইচ্ছাতেই মৌমাছির আক্রমণের স্বীকার হয়েছিলেন ফিরোজ শাহ|কিছু ঐতিহাসিকের মতে ঔরংজেবও এই মন্দির ধ্বংস করতে চেয়ে ব্যর্থ হন|শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিং এই মন্দিরে তাঁদের ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থসাহিব’ নিত্য পাঠ ও দেবীর পূজা করতেন । তিনি ১৮১৫ খ্রীঃ মন্দির সংস্কার করে এক ভব্য মন্দির নির্মাণ করেন|পরবর্তীতে মহারাজা রঞ্জিত সিং দেবীর মন্দিরের চূড়া শোনা দিয়ে বাধিয়ে দেন|
বর্তমানে প্রায় সারা বছরই এই মন্দিরে দর্শনার্থীদের ভীড় থাকে|মন্দিরের আশে পাশে প্রচুর ডালা কেনার দোকান দেখা যায়, যারা যাবেন, তারা মন্দিরের সংলগ্ন দোকান থেকেই নারিকেল, ধূপকাঠি, মোমবাতি, পূজো দেবার শুকনো ফল, সন্দেশ পাবেন । মন্দিরের তোরণদ্বার টি বিশাল। সেখানে শিল্পীর অদ্ভুত কারুকার্যের নিখুত ছোয়া লেগে আছে । দুপাশে দুটি বাঘের মূর্তি, এত সুন্দর মনে হয় যেনো জীবন্ত। বাঘ হল ভগবতীর বাহন । তাই মায়ের মন্দিরে মায়ের বাহন কেউ পূজা করা হয় । এর পর সূর্য কুন্ডের পাশ দিয়ে মন্দিরের দিকে যেতে হয় । সূর্য কুন্ড এক অপূর্ব দিব্য অলৌকিক কুন্ড। মানুষের বিশ্বাস এখানে স্নান করলে সর্ব পাপ নাশ হয় । তাই ভক্তেরা এখানে স্নান সেড়ে ভিক্ষুক দের দান ধ্যান করেন পুন্য লাভের আশায়।পাশেই ভগবান বিষ্ণুর পদচিহ্ন একটি মন্দিরে আছে, পরম শ্রদ্ধায় ভক্তেরা সেখানে ভগবান বিষ্ণুর শরণাগত হয় । মন্দির প্রাঙ্গনে রয়েছে রুদ্রকুন্ড, গোমুখী, ব্রহ্মকুন্ড নামক তিনটি কুণ্ড| রুদ্রকূন্ডর জল অনবরত ফোটে, তবে তাপমাত্রা কম। এই পবিত্র জল স্পর্শের জন্য দীর্ঘ লাইন দেখা যায়| প্রথা অনুসারে এই পীঠ দর্শন করে এখানে একটি অতি প্রাচীন ভগবান রামচন্দ্রের মন্দির দর্শন করতে হয় এবং অবশ্যই উন্মত্ত ভৈরবের দর্শনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ হয় এই তীর্থ যাত্রা |সব মিলিয়ে সারা বিশ্বের হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে অত্যান্ত প্রসিদ্ধ এই শক্তি পীঠ জ্বালামুখী|
আমাদের স্বশরীরে তীর্থ ভ্রমণ আপাতত পরিস্থিতির চাপে অনেকটাই ব্যাহত হচ্ছে তবে যারা একান্তই দেবী শক্তির আরাধনায় অংশগ্রহণ করতে চান তারা অবশ্যই নিজেদের যুক্ত করতে পারেন মা হৃদয়েশ্বরী সর্বমঙ্গলার মন্দিরের সাথে|প্রতিটি বিশেষ তিথিতে পূজা ও অঞ্জলি দেয়ার পাশাপাশি শাস্ত্রমতে গ্রহদোষ খণ্ডনের সু ব্যবস্থাও রয়েছে|এই সম্পর্কে বিশদে জানতে যোগাযোগ করতে পারেন আমার সাথে|দেখতে থাকুন আমার বিশেষ অনুষ্ঠানগুলি আর পড়তে থাকুন আমার এই আধ্যাত্মিক লেখালেখি|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|
বৃহস্পতিবার ও দেবী মহালক্ষী (পর্ব – এক)
হাজার পেশাগত ব্যস্ততার মাঝে সময় বার করে নিয়মিত লেখা লেখি চালিয়ে যাচ্ছি আপনাদের দাবী মেনে|শক্তি পীঠ নিয়ে নিয়মিত লেখা লেখি চলছে তার পাশাপাশি চলছে ভারতের সাধকদের নিয়ে ধারাবাহিক লেখনী|সেই সাথে নব সংযোজন হিসেবে এবার থেকে থাকবে আমাদের নবগ্রহ নিয়ে আমার একটি বিশেষ ধারাবাহিক প্রতিবেদন|যেখানে থাকবে আমাদের গ্রহ গুলির আধ্যাত্মিক স্বরূপ নিয়ে আলোচনা|প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় উৎসব নিয়ে যেমন আমি লিখে থাকি তেমনই আজ শুরু করছি একটি একটি বিশেষ বার বা দিন নিয়ে লেখা, প্রথম পর্বে আজ লিখবো বৃহস্পতিবার নিয়ে, তার আধ্যাত্মিক ও জ্যোতিষ সংক্রান্ত তাৎপর্য ব্যাখ্যা করবো আজকের পর্বে এবং এই আলোচনা হবে দুটি পর্বে|আজ প্রথম পর্ব|
আমাদের জ্যোতিষ শাস্ত্রে বৃহস্পতি অত্যান্ত ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী একটি গ্রহ|বৃহস্পতি ঐশর্য, সম্পদ, শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতার কারক গ্রহ|মূলত শুভ গ্রহ হিসাবে বৃহস্পতিকে দেখা হলেও ফলাফল নির্ভর করে তার অবস্থান ও কারকতার চুলচেরা বিশ্লেষনের উপর|তাই কোনো জাতক জাতিকার জীবনে বৃহস্পতির প্রভাব কেমন হবে তা জন্ম ছক বিচার করে কেবল মাত্র একজন অভিজ্ঞ জ্যোতিষীই বলতে পারে|
আধ্যাত্মিক ভাবে দেখতে গেলে বৃহস্পতিবার হলো লক্ষী বার এই দিনটি দেবী লক্ষীর দিন|সনাতন ধর্মে দেবী লক্ষী অর্থ, সম্পদ ও আধ্যাত্মিকতার দেবী|তিনি স্বয়ং বিষ্ণুর শক্তির আধার|সনাতন ধর্ম মতে এই দিন লক্ষীর আরাধনার মাধ্যমে তাকে সন্তুষ্ট করলে ধন, ঐশর্য ও আধ্যাত্মিক শান্তি লাভ করা যায়|সেই পুরাকাল থেকেই গৃহ কল্যাণের উদ্দেশ্যে বৃহস্পতিবার লক্ষী পুজোর প্রথা প্রচলিত রয়েছে যা হয়তো আমরা অনেকেই মেনে চলি|তবে সঠিক পদ্ধতি না মানলে, উপযুক্ত রীতি নীতি না অনুসরণ করলে কোথাও একটা খামতি থেকে যায়|তাই আমি মনে করি আগে এই দিনটির আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বিশদে জেনে রাখা ভালো|
দেবী লক্ষ্মীর ব্রতকথাগুলির মধ্যে “বৃহস্পতিবারের ব্রতকথা” সবচেয়ে জনপ্রিয়|বহু গৃহে ও মন্দিরে প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর সাপ্তাহিক পূজা হয়ে থাকে|বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীব্রত ও পূজা প্রচলন সম্পর্কে আমাদের শাস্ত্রে একটি লৌকিক গল্পর উল্লেখ রয়েছে|
এক দোলপূর্ণিমার রাতে নারদ বৈকুণ্ঠেলক্ষ্মী ও নারায়ণের কাছে গিয়ে মর্ত্যের অধিবাসীদের নানা দুঃখকষ্টের কথা বললেন। প্রথমে লক্ষ্মী মানুষের নিজেদের কুকর্মের ফলকেই এই সব দুঃখের কারণ বলে চিহ্নিত করলেন।কিন্তু নারদের অনুরোধে মানুষের দুঃখকষ্ট ঘোচাতে তিনি স্বয়ং মর্ত্যলোকে লক্ষ্মীব্রত প্রচার করতে এলেন|
সেই সময়ে অবন্তী নগরে ধনেশ্বর নামে এক ধনী বণিক বাস করতেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলেদের মধ্যে বিষয়সম্পত্তি ও অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া চলছিল|একদিকে বাড়তে থাকা দারিদ্র অন্যদিকে গৃহে সর্বক্ষণ অশান্তি|আর সহ্য করতে না পেরে ধনেশ্বরের বিধবা পত্নী সেই ঝগড়ায় অতিষ্ঠ হয়ে বনে আত্মহত্যা করতে এসেছিলেন|সেই সময় তাকে দেখা দিলেন
মা লক্ষ্মী এবং তাকে বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীব্রত করার উপদেশ দিয়ে ফেরত পাঠালেন|ধনেশ্বরের স্ত্রী নিজের পুত্রবধূদের দিয়ে লক্ষ্মীব্রত করাতেই তাদের সংসারের সব দুঃখ ঘুচে গেল। ফলে লক্ষ্মীব্রতের কথা অবন্তী নগরে প্রচারিত হয়ে গেল
এবং দেখতে দেখতে বৃহস্পতিবারের লক্ষী ব্রতর মাহাত্ম প্রচারিত হলো সমগ্র মর্ত লোকে|
আজও চলছে এই পরম্পরা|কিভাবে সঠিক প্রথা মেনে বৃহস্পতিবার এই পূজা করলে লক্ষীর সম্পূর্ণ কৃপা লাভ করা যায় তা জানাবো আগামী পর্বে তার সাথে থাকবে বৃহস্পতিবার সম্পর্কে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ|পড়তে থাকুন|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|
বৃহস্পতিবার ও মহালক্ষী
লক্ষী বার উপলক্ষে বিশেষ লেখনীর সূচনা করেছিলাম তা আপনাদের ভালো লেগেছে জেনে আমি অতিশয় আনন্দিত, আপনাদের প্রশংসা ও উৎসাহ আমাকে উদ্বুদ্ধ করে আরো ভালো কাজ করতে, আরো বেশি বেশি লিখতে|আজ যথা সময়ে দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে আমি আপনাদের হাজির|আজ লিখবো মা লক্ষীর আটটি ভিন্ন রুপ ও তার অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়ে, জানবো এই রূপ গুলির আধ্যাত্মিক তাৎপর্য আর তার পাশাপাশি থাকবে লক্ষী বারে মা লক্ষীর আরাধনার পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য|
পুরান মতে লক্ষীর জন্ম হয়েছিলো সমুদ্র মন্থনকালে|মন্থনের সময়ে অমৃতকুম্ভ, ঐরাবত, হলাহলের মাঝে উঠেছিলেন দেবী লক্ষ্মীও|
এই যে বৃহস্পতিবার ঘরে ঘরে মা লক্ষীর পূজা হয় তার সাথে সম্পর্ক আছে মা লক্ষীর আটটি রূপের| মা লক্ষীর মোট আটটি অবতার রয়েছে এবং প্রতিটি রূপেরই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট এবং তাৎপর্য রয়েছে|এই এক একটি রূপ প্রকৃতপক্ষে আলাদা আলাদা শক্তির প্রতীক|এই রূপ গুলি হলো যথাক্রমে-
আদি লক্ষী – এই দেবীকেই মহালক্ষী বলা হয়,
মহা লক্ষী হলো মা লক্ষীর আদিরূপ|
এই মা লক্ষী হলেন অফুরন্ত ধনসম্পদের অধিষ্ঠাত্রী|
গজ লক্ষী – গজ মানে হাতি, এই দেবী হাতির ওপর সরাসরি অধিষ্ঠাত্রী না হলেও, তার চারিদিক আবর্ত থাকে হাতি দ্বারা|ধন সম্পদের প্রতীক এই দেবী| পুরান মতে সমুদ্র মন্থন কালে ভগবান ইন্দ্রের হারিয়ে যাওয়া ধন সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন গজলক্ষী|
বিদ্যা লক্ষী – সনাতন ধর্মে বিদ্যার দেবী সরস্বতী হলেও |বিদ্যার প্রতীক এই বিদ্যালক্ষী দেবী|এই দেবী পদ্মের ওপর সাদা শাড়িতে অধিষ্টাত্রী|তিনি জ্ঞান ও ভক্তি প্রদান করেন|
ধনলক্ষী- ধন ও ঐশর্য প্রাপ্তির আশায় সর্বাধিক পূজিতা হন এই দেবী|দেবীর একটি হাত অভয় মুদ্রার ন্যায় রাখা এবং তা থেকে সোনার মোহর বা মুদ্রা বের হয়। বাকি পাঁচটি হাতের প্রতিটি হাতে থাকে একে একে চক্র, শঙ্খ, একটি ঘটে বা পবিত্র কলসি, তীর – ধনুক এবং একটি পদ্ম|দেবী মূলত লাল শাড়িতেই অধিষ্ঠাত্রী|
বিজয়লক্ষী – এই দেবী বিজয়এর প্রতীক স্বরূপ। কোনো সমস্যার থেকে মুক্তি পেতে বা প্রতিকুল পরিস্থিতির উপর বিজয় পেতে এই দেবীর পূজা হয়ে থাকে|
সন্তান লক্ষী – জন সমগ্রে কিছুটা কম পরিচিতা এই দেবী মূলত পরিবারের সন্তানদের মঙ্গলার্থে আবার সন্তান প্রাপ্তির প্রার্থনা স্বরূপ ও পূজিতা হন|
ধান্যলক্ষী – লক্ষীর এই বিশেষ রূপটি খাদ্য শস্য বা কৃষিজ সম্পদের প্রতীক|দেবীর হাতে থাকে শস্যের সমাহার এবং দেবীর পরনে থাকে শস্যের রঙের সবুজ শাড়ি যা প্রকৃতির প্রান শক্তির প্রতীক|
ধৈর্যলক্ষী বা ধরিয়া লক্ষী – এই দেবী হলেন ধৈর্য্যশক্তির প্রতীক। এই দেবীর আরাধনা মনের শক্তি, ধৈর্য্য যোগায় ও একাগ্রতা সৃষ্টি করে|
দেবী লক্ষীর এই রূপের জন্য রয়েছে নিদ্দিষ্ট মন্ত্র ও পূজা পদ্ধতি যা পরে কোনো সময়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে|তবে বৃহস্পতিবার যারা দেবী লক্ষীর আরাধনা করবেন তারা কয়েকটি অতি সহজ ও সাধারন বিষয়ে অবগত হলে অনেক বেশি ফল লাভ করতে পারেন|
ঘর খুব ভালো করে পরিষ্কার রাখুন।
মনে রাখবেন পরিচ্ছন্নতাই এই পুজোর মূল মন্ত্র|পারলে এদিন একটি করে পদ্মফুল দেবীর পায়ে নিবেদন করুন। একটি করে ফল দিন|হলুদ গাঁদায় পুজো করুন। লক্ষ্মীর স্বামী নারায়ণ। তাই একটি করে সাদা ফুল নারায়ণকেও দিন|সপ্তাহের মাত্র এই একটা দিন প্রদীপ সারাক্ষণ জ্বেলে রাখুন।সম্ভব হলে বাড়িতে শ্রীযন্ত্র স্থাপন করুন|
বৃহস্পতিবার ও মা লক্ষীর মহিমা নিয়ে এই বিশেষ প্রতিবেদন আপাতত এখানেই শেষ করলাম, আগামী সময়ে আবার উপস্থিত হবো আপনাদের সামনে|নতুন বিষয় এবং নতুন পর্ব নিয়ে|জ্যোতিষ সংক্রান্ত কাজ নিয়ে যারা যোগাযোগ করছেন তাদের বলবো উল্লেখিত নাম্বারে ফোন করে সরাসরি কথা বলতে পারেন আমার সাথে|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|
গ্রহরাজ
আগেই কথা দেয়া ছিলো যে এক নতুন ধারাবাহিক লেখনী নিয়ে দ্রুত আপনাদের সামনে হাজির হবো|এই বিশেষ পর্ব গুলিতে আলোচনা করবো নবগ্রহ নিয়ে|একেকটা পর্বে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করবো নবগ্রহের একেকটা কে নিয়ে|জানবো তাদের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা, তাদের সাথে জড়িয়ে থাকা নানান পৌরাণিক ঘটনা ও জ্যোতিষ শাস্ত্রে তাদের ভূমিকা|আজ প্রথম পর্ব|শুরু করবো গ্রহরাজ শনিদেবকে দিয়ে|
হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে শনিদেব সূর্যদেব ও সূর্যপত্নী ছায়ার নয় পুত্রের অন্যতম|শনিকে ছায়া পুত্রও বলা হয়ে থাকে|তার গাত্রবর্ণ ঘোর কৃষ্ণবর্নের|তিনি স্বভাবে উগ্র ও বদমেজাজি|সূর্যদেব যখন তার রাজত্ব অর্থাৎ একেকটা লোক একেক জন পুত্রকে বিতরন করলেন স্বভাবতই অখুশি হলেন শনিদেব|পরবর্তীতে ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে নিজের ভাইদের রাজ্য ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করলেন|পিতা সূর্যদেব এই অন্যায় দেখে ও নিজ পুত্রদের শনির হাত থেকে রক্ষা করতে তার আরাধ্য মহাদেবের স্মরণ নিলেন|শিব প্রথমে নন্দী ও বীরভদ্র কে পাঠালেন শনিকে উচিৎ শিক্ষা দিতে
কিন্তু তারা শনিদেবের কাছে পরাজিত হলেন|
এর পর শিব স্বয়ং শনিদেবের মুখোমুখি হলেন এবং তার ত্রিশূলের আঘাতে মূর্ছিত হলেন শনিদেব|পরবর্তীতে সূর্যদেবের অনুরোধে আবার শিব সুস্থ করে দিলেন শনিকে|এবার নিজের ঔদ্ধত্য ও অহংকার ভুলে শনিদেব আত্ম সমর্পন করলেন মহাদেবের চরনে|শিব তাকে ক্ষমা করলেন এবং আশীর্বাদ করলেন তার সাথে নিজের সেবক হিসাবে নিয়োগ কোরলেন শনি কে পাশাপাশি তাকে দিলেন দণ্ডাধীকারীর পদ|অর্থাৎ পাপ পুন্য বিচার করে ফল প্রদান করার অধিকার পেলেন শনি দেব|
শনির ক্ষমতাশালী বা কুখ্যাত দৃষ্টির পেছনেও আছে এক পৌরাণিক ঘটনা|ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে একদিন শনির ধ্যানের সময়, তার স্ত্রী দেবী ধামিনী সুন্দর বেশভূষা নিয়ে তার সামনে এলেন
কিন্তু ধ্যানমগ্ন শনিদেব সেদিকে খেয়াল না করাতে পত্নী ধামিনী বা মন্দা অপমানিত হলেন ও শনিদেবকে অভিশাপ দিলেন, বললেন আমার দিকে তুমি ফিরেও চাইলে না! এরপর থেকে যার দিকে চাইবে, সে-ই ভস্ম হয়ে যাবে!
মূলত সেই থেকেই শনির দৃষ্টিকে অশুভ হিসেবে ধরা হয়|
পুরান সহ আরো বহু শাস্ত্রে শনিদেবকে নিয়ে রয়েছে একাধিক তাৎপর্যপুর্ন ঘটনার উল্লেখ যার মধ্যে দুটি ঘটনা বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং রোমাঞ্চকর|
এবার বীর বজরংবলী কে নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে লড়াইয়ে আহ্বান জানিয়েছিলেন শনিদেব|রাম নামে মগ্ন হনুমান তা প্রত্যাখ্যান করেন কিন্তু ক্রমাগত উত্যক্ত করায় নিজের লেজে জড়িয়ে শুনিদেবকে পাথরের উপরদিয়ে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করেন হনুমান|পরাজিত ও আহত শনিদেব কোনো রকমে ক্ষমা চেয়ে নিস্তার পান|ক্ষতস্থানে তৈল মর্দন করে শান্তি পান|খুব সম্ভবত সেই থেকেই শনিদেবকে তেল নিবেদন করার রীতি চলে আসছে|
আরেকবার লংকাধিপতি রাবনের ক্রোধের কারন হন শনিদেব|ইন্দ্রজিৎ এর জন্মের সময় সব গ্রহ দের কার্যত বন্দী করে একটি নির্দিষ্ট রাশিতে থাকতে বাধ্য করেন রাবন|উদেশ্য এক অজেয় মহাশক্তিশালী পুত্র লাভ|কিন্তু চক্ৰান্ত করে বসেন শনিদেব|নিজের পা প্রসারিত করে অন্য রাশি স্পর্শ করেন|ভেস্তে যায় রাবনের পরিকল্পনা|ধরা পড়ে শাস্তি পান শনিদেব|
আমাদের বৈদিক জ্যোতিষ শাস্ত্রে যে কয়টি অশুভ গ্রহর কথা বলা আছে শনি দেবকে তার মধ্যে অন্যতম বলে মনে করা হয়|যদিও এর বিপক্ষে পাল্টা যুক্তিও আছে|যুগ যুগ ধরে শনিকেনিয়ে যে ভীতি বা আশঙ্কা মানুষের মনের গভীরে বাসা বেঁধেছে তা কিছুটা জ্যোতিষ শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা বা অজ্ঞতার কারনে হয়েছে বলে আমার ধারণা|শনি আসলে কর্ম ফলের কারকগ্রহ|সহজ কথায় ভালোর জন্য ভালো মন্দের জন্য মন্দ|জন্ম ছকে শুনি শুভ না অশুভ তা বলতে গেলে তার অবস্থান, নাক্ষত্রিক সংযোগ, গ্রহগত সংযোগ, দশা অন্তর দশা সহ আরো অনেক কিছুর বিস্তারিত ও চুল চেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন|শনির ঢাইয়া বা সাড়ে সাতি মানেই অশুভ এমনটা সবসময় নয়|শনির দশায় বা সাড়ে সাতি বা ঢাইয়া চলাকালিন জাতক জাতিকার জীবনের ব্যাপক উন্নতিও হতে পারে আবার উল্টোটাও হতে পারে|ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলবো না তবে আমি নিজের জীবনে এই সত্য উপলব্ধি করেছি একাধিক বার|
শনিকে অযথা ভয় পাবেন না, সঠিক জ্যোতিষ পরামর্শ ভাগ্যবিচারের মাধ্যমে আপনার জীবনে শনির প্রভাব কে আগে জানুন ভালো করে তারপর প্রয়োজন হলে উপযুক্ত প্রতিকারের মাধ্যমে প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে উঠুন|আমি আছি আপনাদের পাশে, আছেন মা হৃদয়েশ্বরী সর্বমঙ্গলা|ভয়ের কোনো কারন নেই|প্রয়জনে যোগাযোগ করুন উল্লেখিত নাম্বারে|আজ এই পর্ব এখানেই শেষ করছি|ফিরবো আগামী পর্বে|অন্য এক গ্রহকে নিয়ে|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|
নবগ্রহ – সূর্যদেব
জীবনের দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় কাটিয়ে দিলাম গ্রহ নক্ষত্র দের নিয়ে, শাস্ত্র নিয়ে আর অবশ্যই জ্যোতিষ চর্চা নিয়ে|অগণিত জাতক জাতিকার জন্মছক বিশ্লেষণ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা করেছি |তাদের জীবনে সাফল্য আসতে দেখেছি|বৈদিক জ্যোতিষ শাস্ত্র মূলত মানুষের জীবনে গ্রহ নক্ষত্রর প্রভাব নির্নয় করে এবং সে ক্ষেত্রে প্রতিটি গ্রহর একটি দৈব সত্ত্বা রয়েছে, রয়েছে তাদের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য|নব গ্রহনিয়ে এই লেখালেখি শুরু করেছিলাম গ্রহরাজ শনি কে দিয়ে, আজ দ্বিতীয় পর্বে লিখবো নবগ্রহের প্রথম গ্রহ সূর্যদেব বা রবি কে নিয়ে|জানবো জ্যোতিষ শাস্ত্রে তার ভূমিকা এবং পুরান ও অন্যান্য শাস্ত্রে সূর্যদেব সম্পর্কে কি লিপিবদ্ধ আছে|
সূর্যদেব মূলত বৈদিক দেবতা, বৈদিক যুগে ইনি প্রধান দেবতারূপে পূজিত হতেন ইনি কশ্যপ মুনির এবং অদিতি দেবীর পুত্র|সূর্যের অপর নাম হল আদিত্য|শাস্ত্র মতে শ্রীসূর্য দেব জগতের সকল শক্তির উৎস এবং তিনি অন্ধকারকে নাশ করেন|সূর্য দেবের চারটি হাত । তিনি শঙ্খ, চক্র , ধনুক ও বাণ ধারনকারী |সূর্যদেব সাতটি ঘোড়া যুক্ত রথে চড়ে ব্রহ্মান্ডে ভ্রমণ করেন| তার সারথির নাম অরুণ দেব |সূর্য দেবের সাতটি ঘোড়া সাতটি কিরণকে নির্দেশ করে| কথিত আছে , তার রথ কখনো থামে না |সৌরজগতের রাজা বা অধিপতি হলেন সূর্যদেব|সূর্যদেবের দুই জন স্ত্রী ছায়া ও সংজ্ঞা মতান্তরে , সংজ্ঞা ও সন্ধ্যা|জম,শনি, যমুনা সূর্যের সন্তানদের অন্যতম|অস্বীনি কুমার এবং সুগ্রীব ও সূর্যদেবেরই সন্তান|সূর্যদেব থেকেই সূর্য বংশের সৃষ্টি|
কথিত আছে- সূর্যপত্নী সংজ্ঞা সূর্যের তাপ সহ্য করতে অসমর্থ হলে, সংজ্ঞার পিতা বিশ্বকর্মা সূর্যকে মোট ১২টি ভাগে ভাগ করেন এবং এই আটটি ভাগ পৃথিবীতে পতিত হলে বিশ্বকর্মা এগুলি থেকে শক্তি সঞ্চয় করে বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিবের ত্রিশূল, কুবেরের অস্ত্র, কার্তিকেয়ের তরবারি ও অন্যান্য দেবতাদের অস্ত্র নির্মাণ করে দেন|
বিভিন্ন পুরানে ও ধর্মগ্রন্থে সূর্যদেবকে নিয়ে রয়েছে অসংখ্য ঘটনার উল্লেখ, যার সব গুলি এতো অল্প পরিসরে তুলে ধরা অসম্ভব তবে কয়েকটি ঘটনার কথা বলবো-
অমৃত পানকালে প্রতারক দানব রাহুকে চিহ্নিত করেন সূর্যদেব ও চন্দ্রদেব এবং এইজন্য তাঁরা রাহুর চিরশত্রুতে পরিণত হন ও প্রতিশোধ স্বরূপ রাহু সাময়িকভাবে সূর্য ও চন্দ্রকে গ্রাস করেন| এ ক্ষেত্রে কোনো দেবগণ সূর্যদেবকে সাহায্য না করায় সূর্যদেব ক্রোধিত হলেন এবং এর ফলে তিনি অসীম তেজবৃদ্ধি করলেন|সূর্যের তেজের ফলে সৃষ্টি ধ্বংস হবার উপক্রম হলে ব্রহ্মাদেব অরুণ দেবকে সূর্যের সারথি করলেন এবং তাকে শান্ত হতে অনুরোধ করলেন|অবশেষে তিনি শান্ত হলেন ও রক্ষা পেলো ব্রম্হান্ড|অর্থাৎ সূর্যের তেজ যেমন সৃষ্টির উৎস তেমনই অতিরিক্ত তেজ সৃষ্টির ধ্বংসের কারনও হতে পারে|
একবার রাবণ দিগ্বিজয়ে বের হয়ে, সুমেরু শিখরে রাত্রি যাপন করেন এবং পরদিন পুষ্পক রথে চড়ে সূর্যলোকে যান। সেখানে সূর্যের তেজে কাতর হয়ে তিনি প্রহস্ত নামক এক অনুচরকে দিয়ে সূর্যের সাথে যুদ্ধ করার প্রস্তাব পাঠান। সূর্য তার দণ্ডী নামক এক অনুচরকে দিয়ে বার্তা পাঠান ‘তুমি রাবণের নিকট যাও এবং তাকে হয় পরাজিত কর, না হয় বলো পরাজিত হলাম।’ দণ্ডী এই কথা সূর্যকে জানালে, রাবণ নিজেকে জয়ী ভেবে ফিরে যান|
মহাভারতে উল্লেখ আছে- কুন্তী দেবী দুর্বাসার কাছ থেকে বর পেয়ে সূর্যকে আবাহন করলে, সূর্য কুন্তীর সাথে মিলিত হন। এই মিলনের ফলে কর্ণ নামক মহাবীরের জন্ম হয়|
বৈদিক জ্যোতিষ শাস্ত্রে সূর্য সবথেকে প্রভাব শালী ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রহগুলির অন্যতম|সূর্য একা ধারে পিতৃ কারক গ্রহ এবং কর্ম, প্রভাব, প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠাকে নির্দেশ করে|সূর্য ভালো থাকলে জাতক জাতিকার নাম, যশ ও অর্থাৎ লাভের পথ প্রশস্ত হয়ে|সূর্যের অশুভ প্রভাব বা অবস্থান জাতক জাতিকার জীবনে সাফল্য অর্জনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়| পিতার স্বাস্থ বা আর্থিক অবস্থাও নির্ভর করে সূর্যের অবস্থানের উপর|জ্যোতিষ শাস্ত্রে চন্দ্র যেমন মন মানসিকতা কে প্রভাবিত করে সূর্য তেমন দেহ ও ব্যক্তিত্ব কে প্রভাবিত করে|আবার কোনো গ্রহ যদি সূর্যের অতিরিক্ত কাছে এসে পরে তা সূর্যের তেজে শক্তিহীন হয়ে পরে তখন তাকে আমরা দগ্ধ গ্রহ বলি|
তবে একজন জাতক বা জাতিকার জীবনে সূর্যের প্রভাব ঠিক কি হবে তা সঠিক ভাবে বলতে গেলে একটি জন্মছককে খুঁটিয়ে দেখে, বিশ্লেষণ করে তারপর কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ এবং তা পারেন কোনো অভিজ্ঞতা সম্পন্ন জ্ঞানী জ্যোতিষী|
সঠিক ভাগ্যবিচার ও প্রয়োজন হলে প্রতিকার এটাই জ্যোতিষ শাস্ত্রের মুল কথা|যদি জ্যোতিষ শাস্ত্রে বিশ্বাস থাকে, যদি সঠিক জ্যোতিষ পরামর্শ ও প্রতিকারের মাধ্যমে জীবনের বাঁধা বিপত্তি কাটিয়ে এগিয়ে যেতে চান|নির্দ্বিধায় যোগাযোগ করুন উল্লেখিত নাম্বারে|আপনাদের পন্ডিতজি আপনাদের পাশে থাকবে। ভালো থাকবেন । ধন্যবাদ।
শক্তি পীঠ – বৃন্দাবন
কিছুকাল আগে আপনাদের ইচ্ছায় ও উৎসাহে শুরু করেছিলেন শক্তি পীঠ নিয়ে লেখা লেখি, মাঝ খানে আরো অনেক কিছু নিয়েই লিখতে হয়েছে, আগামী দিনেও চলবে|তবে খেয়াল করে দেখলাম বেশ দীর্ঘ সময় হয়ে গেলো নতুন কোনো শক্তি পীঠ পর্ব নিয়ে আপনাদের সামনে আসা হয়নি|আজ আর দেরি না করে চলে এসেছি একটি বিশেষ শক্তি পীঠের কথা নিয়ে|আজ লিখবো একান্ন শক্তি পীঠের অন্যতম শক্তি পীঠ বৃন্দাবন নিয়ে|
বৃন্দাবন বলতেই মনে আসে বৈষ্ণব সম্প্রদায়, রাধা কৃষ্ণের আরাধনা, গোপীনি দের রাশ লীলা, হরিনাম সংকীর্তন ইত্যাদি|এতো কিছুর মাঝে, এই বৃন্দাবনের পবিত্র ভূমিতেই রয়েছে শক্তি পীঠ কাত্যায়নী দেবীর মন্দির দেবী উমা বা যোগমায়া নামেও পরিচিত|দেবীর ভৈরব হিসেবে এই স্থানে পূজিত হন ভূতেশ|
সুদর্শন চক্রে খণ্ডিত দেবীর শরীরের কোন অংশ এই বিশেষ স্থানে পতিত হয়েছিলো তা নিয়ে দুটি ভিন্ন মত রয়েছে|একটি মত অনুসারে এখানে দেবী সতীর কেশ রাশি পড়েছিলো আর দ্বিতীয় মত অনুসারে এই স্থানে পড়েছিলো দেবীর আংটি|এই বিতর্ক যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এবং হয়তো এর কোনো শেষ নেই|
দেবীর নবদূর্গা রূপের একটি রূপ এই কাত্যায়নী|
দেবীর মন্দিরেটি অবস্থিত বৃন্দাবনের কেশী ঘাটে যা নব 1923 সালে নবরূপে নির্মান করান যোগীরাজ স্বামী কেশবানন্দ|এই মন্দিরে দেবী মূর্তির পাশাপাশি রয়েছে একটি প্রাচীন তলোয়ার যার নাম উচ্ছল চন্দ্রহাস|দেবীর ভৈরব অর্থাৎ ভুতেশ্বর মহাদেবের মন্দিরটি রয়েছে বৃন্দাবনের ভুতেশ্বর রোডের কাছে|
ভক্ত রা বিশ্বাস করেন দেবী উমার পূজা করলে ভয়, শোক, দুক্ষ এবং ক্রোধ দূর হয়|মনে শান্তি ও শক্তির সঞ্চার হয়|ভাগবত পুরান অনুসারে গোপিনীরা কৃষ্ণকে পাওয়ার আশায় সারা মাঘ মাস জুড়ে কাত্যায়নী ব্রত পালন করতেন এবং এই সময়ে তারা প্রতিদিন যমুনায় স্নান করে যমুনা নদীর মাটি দিয়ে দেবী মূর্তি গড়ে নিষ্ঠা সহকারে বিধিসম্মত ভাবে দেবীর পূজা করতেন|
বৃন্দাবনে অবস্থিত এই শক্তি পীঠ ভক্ত দের কাছে বেশ জনপ্ৰিয়|তীর্থে আশা বহু মানুষ এই পীঠ দর্শন করেন, পূজা দেন ও দেবীর আশীর্বাদ নেন|আপনারাও চাইলে মথুরা বা বৃন্দাবন ভ্রমণকালে একবার দর্শন করতে পারেন দেবীর|
আজকের মত এই পর্ব এখানেই শেষ করছি|আগামী পর্বে নিয়ে আসবো অন্যকোনো শক্তি পীঠের কথা|আপনাদের জানিয়ে রাখি যারা মা হৃদয়েশ্বরী সর্বমঙ্গলা মন্দিরের সাথে যুক্ত হতে চান সরাসরি উল্লেখিত নাম্বারে যোগাযোগ করে আমার সাথে কথা বলতে পারেন|প্রায় প্রতিটি বিশেষ তিথিতে মায়ের মন্দিরে বিশেষ পূজা, গ্রহ দোষ খণ্ডন ও ভোগ বিতরনের সু ব্যবস্থা থাকে|আসুন, মা সর্বমঙ্গলা আপনাদের মঙ্গল করবেন|ভালো থাকুন |ধন্যবাদ|
পৌরানিক অসুর কথা – ভষ্মাসুর
আমাদের পুরান তথা অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থে বর্ণিত সর্বাধিক আলোচিত, জনপ্রিয় এবং রোমাঞ্চকর বিষয় হলো দেবাসুর দ্বন্দ|একদিকে যেমন আছেন প্রবল পরাক্রমী দেবতারা অন্যদিকে তেমন আছেন একাধিক শক্তিশালী অসুর|দেবতাদের কথা আমি বহু ভাবে লিখি, আলোচনা হয়, আপনারাও আপনাদের মতামত জানিয়ে সমৃদ্ধ করেন আমাকে|কিন্ত এবার দেবতাদের পাশাপাশি লিখবো অসুরদের নিয়ে, সম্পূর্ণ নতুন এই ধারাবাহিক লেখনীতে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে থাকবেন কিছু বলশালী অসুর যাদের কথা হয়তো আমরা আগে শুনেছি কিন্তু অন্য আঙ্গিকে|আজকের পর্ব শুরু করার আগে অসুর সংক্রান্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আপনাদের সামনে তুলে ধরবো|
আসলে যেকোনো ধর্মে বা সংস্কৃতিতে শুভ ও অশুভ শক্তির এক চীরপরিচিত দ্বন্দ আমরা দেখতে পাই|সহজ করে বললেন দিন থাকলে রাত থাকবেই আবার আলো থাকলে অন্ধকার থাকবেই তেমনই সনাতন ধর্ম গ্রন্থ গুলিতে শুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে রয়েছেন দেবতারা তেমনই অশুভ শক্তি বা ধ্বংসাত্মক শক্তির প্রতীক রূপে রয়েছেন অসুররা|এটাই সৃষ্টির নিয়ম|এভাবেই চলে আসছে বিশ্ব ব্রম্হান্ড আদি অনন্ত কাল ধরে|তবে গোড়া থেকেই অসুর মানেই অশুভ বা ক্ষতিকারক শক্তি ছিলোনা|বেদের প্রথম খন্ডে অসুর শব্দ প্রশংসা সূচক ছিল|অসুর শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ হলো বীর যোদ্ধা|সৃষ্টির একদম আদি লগ্নে দেবাসুর মৈত্রীর কোথাও জানা যায় বহু প্রাচীন শাস্ত্র থেকে|পরবর্তীতে ক্ষমতা বিস্তারের উদ্দেশ্যে শুরু হয় দেবাসুর সংগ্রাম এবং এই সময় থেকে ধীরে ধীরে অসুররা পরিনত হয় অন্ধকারের প্রতীকে|অন্য দিকে বেদ শাস্ত্র এবং যজ্ঞ কে অবলম্বন করে দেবতারা হয়ে ওঠেন সর্বশ্রেষ্ঠ|
এই ধারাবাহিক লেখার একেকটি পর্বে আমি আলোচনা করবো এক এক জন অসুরকে নিয়ে, জানবো তার সাথে জড়িয়ে থাকা পৌরানিক ঘটনাবলী ও তার ব্যাখ্যা|আজ প্রথম পর্বে জানবো ভস্মাসুরের কথা|
দেবাদিদেব মহাদেবে শুধু দেবতাদের আরাধ্য দেবতা নন তিনি ভূত প্রেত অসুর দৈত্য দেরও আরাধ্য দেবতা|এই দেবাদিদেব মহাদেবকে তপস্যায় তুষ্ট করে অমরত্বের বর চেয়ে বসলেন এক অসুর তার নাম ভস্মাসুর|কিন্তু অমরত্ব প্রদান করা সম্ভব নয় তাই মহাদেব অন্য বর চাইতে বললেন|ভষ্মাসুর চাইলেন যার মাথায় সে হাত রাখবে সেই যেনো ভষ্ম হয়ে যায়|হাসি মুখে বরদান করলেন মহাদেব|বর পেয়ে তার প্রথম শিকার হিসেবে ভস্মাসুর স্বয়ং মহাদেবের মাথায় হাত রাখতে চাইলেন|কোনো ক্রমে সেই স্থান ত্যাগ করলেন মহাদেবে কিন্তু তার পিছু নিলেন ভষ্মাসুর|অবশেষে বিষ্ণুর স্মরণ নিলেন মহাদেব|
বিষ্ণু মোহিনী অবতারে ভষ্মাসুরের সম্মুখে অবতীর্ন হলেন মোহিনীর রূপে মুগ্ধ হয়ে ভষ্মাসুর তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন|শর্ত হিসেবে নারী রুপী বিষ্ণু ভষ্মাসুরকে তার সাথে নৃত্যে অংশ নিতে বাধ্য করলেন|নৃত্যরত ভষ্মাসুর সবকিছু ভুলে হটাৎ নিজের মাথায় হাত রেখে বসলো|ব্যাস ফলে গেলো মহাদেবের বর|ভষ্ম হলেন ভষ্মাসুর এবং সে যাত্রায় রক্ষা পেলেন মহাদেব|
আরকেটি পৌরানিক ব্যাখ্যা অনুসারে বিষ্ণুর মোহিনী অবতার ভষ্মাসুর কে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নদীতে স্নান করে পবিত্র হয়ে আসতে বলেন|স্নান কালে ভুল বসত মাথায় হাত দিয়ে নিজেকে নিজে ভষ্ম করে ফেলে ভষ্মাসুর|প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় এই মোহিনী অবতার ও শিবের একটি বরপুত্র আছেন যার নাম আয়াপ্পা|দক্ষিণ ভারতে ইনি খুবই জনপ্রিয় এবং কার্তিক রূপে পূজিত হন|
আমাদের পুরানে অসংখ্য বার এমন দেবাসুর দ্বন্দ্ব বেঁধেছে এবং অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে জয়ী হয়েছে শুভ শক্তি|রক্ষা পেয়েছে স্বর্গ মর্ত সহ গোটা সৃষ্টি|সেই সব গল্প এক এক করে আপনাদের সামনে আনবো আগামী পর্বগুলিতে|পড়তে থাকুন আমার লেখা গুলি এবং জোতিষ সংক্রান্ত পরামর্শ বা প্রতিকারের জন্য সরাসরি উল্লেখিত নাম্বারে ফোন করে কথা বলতে পারেন আমার সাথে|জয় মা হৃদয়েশ্বরী সর্বমঙ্গলার জয়|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|
পৌরাণিক অসুর কথা – বৃত্রাসুর
এই ব্যতিক্রমী ধারাবাহিক লেখনী আপনাদের ভালো লাগছে জেনে উৎসাহিত বোধ করছি তাই ধারাবাহিকতা বজায় রেক্যে পৌরানিক অসুর কথার দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে আজ আপনাদের সামনে উপস্থিত|এই পর্ব গুলিতে পুরানে উল্লেখিত অসুর চরিত্র গুলিকে সামনে রেখে বা কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে তাদের ব্যবহার করে সহজ সরল ভাবে একাধিক দেবাসুর সংগ্রামের কাহিনী আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি|এই প্রচেষ্টায় আমি কতোটা সফল তা আপনারা বলবেন তবে আমি চেষ্টা করবো আগামী মহালয়া অবধি এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে|আজ দ্বিতীয় পর্বে লিখবো অসুর বৃত্রাসুর কে নিয়ে|
আপনারা অনেকেই হয়তো পড়েছেন বা জানেন দধীচি মুনির কথা তার আত্মত্যাগের কথা এবং দেবরাজ ইন্দ্র কতৃক বৃত্রাসুর বধ হওয়ায় দধীচি মুনির কি অবদান ছিলো|কিন্তু আজ বিস্তারিত জানবো কে এই বৃত্রাসুর, কি তার জন্ম বৃত্তান্ত তারপর আসবো দধীচি মুনির আত্মত্যাগ এবং বৃত্রাসুর বধ হওয়ার ঘটনায়|
দেব শিল্পী বিশ্বকর্মা একবার ইন্দ্রের প্রতি কোনো কারনে বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ হয়ে এক প্রবল পরাক্রমী যোদ্ধা সৃষ্টি করলেন যার নাম বিশ্বরূপ|এই বিশ্বরূপ চূড়ান্ত ক্ষমতা অর্জনের লক্ষে শুরু করলেন কঠোর তপস্যা|তার আসল উদেশ্য ও তপস্যায় ভীত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র নানা ভাবে তার তপস্যা ভঙ্গ করতে চাইলেন কিন্তু ব্যর্থ হলেন শেষে ছলের আশ্রয় নিয়ে ইন্দ্র তাকে বধ করলেন|এই ঘটনায় প্রচন্ড রেগে গেলেন বিশ্বকর্মা এবং এক অধিক শক্তিশালী পুত্র লাভের আশায় এক বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করলেন|অবশেষে সেই যজ্ঞের হোমঅগ্নি থেকে সৃষ্টি হলো বৃত্রাসুরের|
বৃত্রাসুরের জন্ম রহস্য নিয়ে আরেকটি পৌরাণিক মতবাদ প্রচলিত আছে যেখানে বলা হচ্ছে বৃত্রাসুর প্রজাপতি ত্বষ্টার পুত্র এক অসুর। ইন্দ্র ত্রিশিরাকে বধ করলে ত্বষ্টা ত্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্রকে বিনষ্ট করার জন্য অগ্নিতে আহুতি দিয়ে বৃত্রাসুরকে উৎপন্ন করেন|
কোন পৌরানিক ঘটনা ঠিক এবং কোন ঘটনা ভুল সেই বিতর্কে জড়ালে আসল ঘটনা চাপা পড়ে যাবে তাই ওই আলোচনা তোলা থাক ভবিষ্যতের জন্য|
বৃত্রাসুর ইন্দ্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঘোষণা করেন,বৃত্রাসুর গিয়ে ইন্দ্রকে আতর্কিতে গ্রাস করেন। বৃত্রাসুর মুখ হাঁ করলে ইন্দ্র অবশ্য দেহ সংকুচিত করে বেরিয়ে আসতে পারলেন, কিন্তু বহুকাল যুদ্ধ করেও ইন্দ্র বিত্রাসুরকে পারাজিত করতে পারলেন না এবং বৃত্রাসুর ইন্দ্রকে পরাজিত ও স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করলেন কিন্তু এতেও তার ক্রোধ ঠান্ডা হলো না|ইন্দ্রকে বধের উদ্দেশ্যে বৃত্রাসুর কঠোর তপস্যা শুরু করলেন|
ইন্দ্রের প্রান সংশয় দেখা দিলে ঋষিরা বৃত্রকে ইন্দ্রের সঙ্গে সন্ধি করার প্রস্তাব দিলেন বৃত্র সব শুনে বললেন যে, তিনি তাতে রাজি আছেন। কিন্তু ঋষিদের কথা দিতে হবে যে, শুষ্ক বা আদ্র্র বস্তু দ্বারা, প্রস্তর কাষ্ঠ বা অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা, দিবসে বা রাত্রিতে ইন্দ্র অথবা অন্যদেবতারা ওঁকে বধ করতে পারবেন না। ঋষিরা তাতে রাজি হলে সন্ধি স্থাপিত হল।অর্থাৎ দেবতা দের সব অস্ত্র সস্ত্র বৃত্যাসুর কে বধ করার ক্ষমতা হারালো|
এদিকে ক্রমে বৃত্যাসুর যখন অত্যাচারি হয়ে উঠতে লাগলো এবং এক সময় তাকে বধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় রইলো না, কিন্তু অস্ত্র নেই | তখন ঋষিরা ঠিক করলেন কোনো ত্যাগী এবং তেজময় সন্যাসীর অস্থি থেকে অস্ত্র তৈরী করে বৃত্যাসুর কে বধ করতে হবে|
ত্যাগের জন্য নির্বাচিত সেই মহান বৈদিক ঋষি হলেন দধীচি|বলা হয় শিবের বরে দধীচি মুনি বজ্র কঠিন অস্থি পেয়ে ছিলেন|এখানে দধীচি মুনির পরিচয়টাও সংক্ষেপে দিয়ে রাখা প্রয়োজন, ভগবত্ পুরাণ অনুযায়ী তিনি অথর্বন ঋষি ও চিতির পুত্র |বিশ্বস করা হয় এই অথর্বন ঋষিই রচনা করেছিলেন অথর্ব বেদ |পাণিনী তাঁর অষ্টাধ্যয়ীতে ব্যাখ্যা করেছেন তার নামের অর্থ |দুধ বা দধি থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে তিনি শক্তিশালী হয়েছিলেন তাই তার না দধীচি|
পরিকল্পনা অনুযায়ী দেবতারা দধীচীর কাছে তার অস্থি চাইলেন|এই অনুরোধ শুনে দধীচি নামক এই মহুমুনি সাধক আত্মত্যাগ করতে রাজি হন। দধীচিকে হত্যা করা হয় এবং তার দেহের হাড় দিয়ে বৃত্তাসুরকে হত্যার জন্য ইন্দ্রের জন্য একটি বিশেষ বজ্র তৈরি করা|ইন্দ্রের প্ৰিয় অস্ত্র ত্রিশিরা কে বধ করার সময় ধ্বংস হয়েছিলো|তার পর ইন্দ্র ও বৃত্তাসুরের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হলো|অবশেষে সেই বজ্র দিয়ে ইন্দ্র একটি বিশেষ সময়ে বৃত্রাসুর কে যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং হত্যা করেন |একদিকে ঋষি দের বর অটুট থাকলো অন্যদিকে অশুভ শক্তির বিনাশ হলো বৃত্রাসুরের হাত থেকে রক্ষা পেলেন ইন্দ্র|রক্ষা পেলো স্বর্গ তথা গোটা সৃষ্টি|ইন্দ্র কে অবশ্য বৃত্রাসুর বধের পর বিশেষ যজ্ঞের মাধ্যমে ব্রহ্মহত্যার পাপ খণ্ডন করতে হয়েছিলো|
আমাদের শাস্ত্রে দধীচি মুনির এই আত্মত্যাগ স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে, দেবতারা যেমন শুভ শক্তির এবং অসুররা যেমন অশুভ শক্তির প্রতীক ঠিক তেমনই দধীচি মুনি হলেন আত্মত্যাগের প্রতীক যিনি হাসি মুখে নিজের প্রান বিসর্জন দিয়ে ছিলেন জগতের কল্যানে|
বৃত্রাসুরের কথা আপাতত এখানেই শেষ করছি|ফিরে আসবো পরের পর্বে অন্য কোনো অসুরের কথা নিয়ে|চোখ রাখুন আমার ইউটিউব ও ফেসবুকের লাইভ অনুষ্ঠানে আর অনলাইন জ্যোতিষ পরামর্শ বা প্রতিকারের জন্য ফোন করুন আমাকে|কথা হবে|ভালো থাকুন|
পৌরানিক অসুর কথা – মহিষাসুর
পন্ডিতজি ভৃগুর শ্রী জাতক
অমাবস্যা ও মহালয়া আসন্ন তাই এই তিথি কে কেন্দ্র করে অসংখ্য মানুষ শাস্ত্র মতে তাদের গ্রহ গত দোষ খণ্ডনের জন্য যোগাযোগ করছেন সেই কারনে পেশা গত ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে|তবে ধারাবাহিক লেখনীর যে দায়িত্ব হাতে নিয়েছি তাকেও সমান গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে বিবেচনা করে আজ পৌরানিক অসুর কথার একটি বিশেষ পর্ব নিয়ে আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত|আজকের পর্বে মহিষাসুর|
অসংখ্য দেব দেবীর পাশাপাশি আমাদের পুরানে অসুরের সংখ্যাও কিছু কম নয়|এদের কয়েকজনের কথা আমি আপনাদের ইতিমধ্যে বলেছি|তবে সব থেকে আলোচিত এবং জনপ্রিয় অসুর চরিত্র বোধহয় মহিষাসুর|দেবী দুর্গার সাথে পূজিত হওয়ার দরুন মহিষাসুর বাংলা তথা গোটা বিশ্বের দরবারে এক অতি পরিচিত মুখ|তার বোধ হওয়ার কাহিনী হয়তো আমরা সবাই জানি কিন্তু তার জন্ম বৃত্তান্ত সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অনেকেরই অজানা|আজ চেষ্টা করবো মহিষাসুর সম্পর্কে কিছু স্বল্প প্রচারিত বিষয়ে আলোকপাত করার|
মহিষাসুরের পিতাও ছিলেন এক অসুর তার নাম রম্ভ|অগ্নিদেবকে মতান্তরে মহাদেবকে তপস্যায় প্রসন্ন করে রম্ভ বর লাভ করেছিলো যে সে এক ত্রিকাল জয়ী বলশালী পুত্রের পিতা হবে|এই পুত্রকে কোনো পুরুষ বোধ করতে পারবেনা|পরবর্তীতে এক মহিষী কে ভালো বেশে তার সাথে মিলিত হয় রম্ভ|কিছুকাল পরে এক মায়াবী মহিষের সাথে সংঘর্ষে মৃত্য হয় রম্ভের|যক্ষেরা মিলে রম্ভর চিতায় অগ্নি সংযোগের ব্যবস্থা করে|রম্ভের অর্ধাঙ্গিনী সেই মহিষীও রম্ভার সাথে মৃত্যু বরণ করতে চেয়ে সেই চিতায় উঠে বসে|কিন্তু দেবতাদের বর মিথ্যে হতে পারেনা তাই সেই জ্বলন্ত চিতায় মাতৃ গৰ্ভ থেকে বেড়িয়ে আসে এক অসুর শিশু|এই শিশুই পরবর্তীতে হয় মহিষাসুর|
পরবর্তীতে অত্যাচারী হয়ে ওঠে মহিষাসুর ও স্বর্গ মর্ত পাতাল অধিকার করে নেয়|তাকে বোধ করতে আবির্ভুত হন দশ ভুজা দেবী দূর্গা|মহিষাসুর কে বধ করে দেবী হন মহিষাসুর মর্দিনী|
ত্রিকাল জয়ী বীর যোদ্ধা মহিষাসুরকে বধ করা সহজ ছিলোনা|মহিষাসুর একাধিক বার একাধিক রূপে দেবীর সাথে যুদ্ধ করেছিলেন|দেবীর দুর্গাও একাধিক রূপে একাধিক বার তার বিনাশ করেছেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে|মহিষাসুর জন্মগ্রহণ করেন তিনবার। ত্রিবিধ রূপ ধারণ করে তাঁকে তিনবারই বিনাশ করেন এই দেবী। মহিষাসুরকে বধ করার জন্য প্রথমে অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডা রূপে, দ্বিতীয়বার ভদ্রকালী এবং তৃতীয়বার বধ করলেন দশভুজা দেবী দুর্গা রূপে|দেবীর এই দশ ভুজা মহিষাসুর মর্দিনী রুপই পূজিত হয় বাংলার ঘরে ঘরে|
দেবী মূর্তির সাথে সর্বত্র মহিষাসুর কেনো পূজিত হন শাস্ত্রে এরও নিদ্দিষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে|মৃত্যুর পূর্বে মহিষাসুর স্বপ্নে দেবীর দর্শন করেন এবং দেবীকে অনুরোধ করে বলেন যে আপনার হাতে মৃত্যুর জন্য কোনও দুঃখ বা ক্ষোভ নেই এতটুকুও। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমিও যাতে সকলের পূজিত হই তারই ব্যবস্থা করুন দেবী। এছাড়া আর কিছুই চাই না আমি।’দেবী তখন মহিষাসুরকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘উগ্রচণ্ডা, ভদ্রকালী আর দুর্গা, এই তিন মূর্তিতে আমার পদলগ্ন হয়ে তুমি সব সময়েই পূজ্য হবে দেবতা, মানুষ ও রাক্ষসদের।’ সেই থেকেই এই রীতি প্রচলিত|
আমাদের দেশের কিছু আদিবাসী ও বিশেষ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আশ্চর্য জনক ভাবে মহিষাসুরকে প্রধান আরাধ্য দেবতা হিসেবে পূজা করার রীতিও আছে|এমনকি উত্তর বঙ্গের একটি বিশেষ জন সমাজ নিজেদের আজও মহিষাসুরের বংশধর বলে দাবী করে ও যথেষ্ট গর্ব অনুভব করে|
আজ মহিষাসুর কে নিয়ে এই পর্ব এখানেই শেষ করছি|মহালয়া উপলক্ষে আপনাদের হৃদয়েশ্বরী সর্বমঙ্গলা মায়ের মন্দিরে বিশেষ পূজা, হোম যজ্ঞ ও গ্রহ দোষ খণ্ডনের ব্যবস্থা করা হয়েছে|প্রযুক্তির ব্যবহারে এই আধ্যাত্মিক কর্মকান্ড পৌঁছে দেয়া হবে আপনাদের কাছে|যোগাযোগ করুন, যুক্ত হন এবং সাক্ষী থাকুন এক অভূতপূর্ব আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|