শক্তি পীঠ – জ্বালা মুখী

664

বহুদিন পর আজ একটি শক্তিপীঠ নিয়ে বলবো|আজকের পর্বে আলোচনা করবো শক্তিপীঠ জ্বালামুখী নিয়ে|এই পীঠটি বিশেষ, কারন বহু ঐতিহাসিক, অলৌকিক ও আধ্যাত্মিক বিস্ময় জড়িয়ে আছে এই পীঠের সাথে|মানুষের মধ্যে এই পীঠ নিয়ে কৌতূহলের কোনো সীমা নেই, তার পাশাপাশি আছে অটুট বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও ভক্তি|আসুন শুরু করা যাক আজকের শক্তিপীঠ পর্ব জ্বালামুখী|

তন্ত্র শাস্ত্রে এই পীঠ সম্বন্ধে বলা হয় – “জ্বালামুখ্যাঁ তথা জিহ্বা দেব উন্মত্ত ভৈরবঃ অম্বিকাসিদ্ধিনান্মী”
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যেও এই পীঠের উল্লেখ আছে, সেখানে বলা হচ্ছে-
“জ্বালমুখে জিহ্বা তাহে অগ্নি অনুভব
দেবী অম্বিকা নাম উন্মত্ত ভৈরব”

ভারতের হিমাচল প্রদেশের কাংড়া উপত্যকায় অবস্থিত জ্বালা মুখী শক্তি পীঠ পুরান মতে এখানেই কালীধর পাহাড়ে কোথাও দেবী সতীর জিহ্বা পতিত হয়েছিল। দেবতাদের তেজ সম্পন্ন হয়ে একটি অগ্নিশিখা সর্বদা নাকি জ্বলছে । রাজা ভূমিচন্দ্র সেই স্থানের অনেক সন্ধান করেন কিন্তু খুঁজে না পেয়ে নগরকোটের সামনে একটি দেবীর মন্দির নির্মাণ করেন পরে একদিন রাজা এক গোয়ালার কাছে দেবীর অগ্নি শিখার কথা শুনলেন এবং সেই স্থান খুঁজে পেয়ে সেখানেই দেবীর মন্দির নির্মাণ করলেন ।মহাভারত কালে নাকি পঞ্চপাণ্ডব এই স্থার্ন মন্দির নির্মাণ করেছিলেন এমনটাও শোনা যায়|বহু কিংবদন্তী ও অলৌকিক মহিমা প্রচারিত আছে এই শক্তি পীঠ ঘিরে|

এই পীঠের দেবী হলেন- সিদ্ধিদা আর ভৈরব হলেন উন্মত্ত । আবার কারোর মতে এই পীঠের দেবী হলেন অম্বিকা, ভৈরব হলেন উন্মত্ত । আবার কিছু পণ্ডিত দের মত দেবী হলেন অম্বিকা, ভৈরব হলেন বটুকেশ্বর|মন্দিরের কাছেই এক পাহাড়ে ভৈরব বিরাজমান |মায়ের মন্দিরে কোনো বিগ্রহ নেই|এক জ্বলন্ত দিব্য অগ্নি শিখাকে দেবী রূপে পূজা করা হয়|মায়ের মন্দিরের উত্তর দিকের দেওয়ালের মাঝে মায়ের মূল জ্যোতি বা আগুনের শিখা বিরাজমানা|
বলা হয় এই আগুনের শিখাই হলেন মা জগদম্বা সিদ্ধিদা, অম্বিকা,জ্বালামুখী| ভক্তেরা যে যে নামে ডাকবে মা তাদের কে সেই রূপেই কৃপা করবেন । এই আগুনের শিখা অনবরত জ্বলছে| কোনদিন নেভেনি |

বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই শক্তি পীঠ| মুঘল সম্রাট আকবর, দেবীর মহিমা প্রত্যক্ষ করতে একবার এই পীঠে আসেন। আবুল ফজলের রচিত ‘আইন- ই – আকবরি’ তেও এই পীঠের কথা উল্লেখ আছে । প্রথমে আকবর, মা জুয়ালার ক্ষমতাকে বিশ্বাস করতেন না পরে দেবীর অলৌকিক ক্ষমতার প্রমান পেয়ে আকবর , দেবীর মহিমা স্বীকার করেন এবং দেবীর মন্দিরে একটি সোনার ছাতা প্রদান করেন|একবার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরোজ শাহ জ্বালা দেবীর মন্দির লুঠপাঠ ও ধ্বংস করার জন্য রওনা হয়েছিলেন কিন্তু পথে এক জায়গা তে তারা মৌমাছিল আক্রমণের শিকার হলেন| কাতারে কাতারে ফিরোজের সেনারা মৌমাছির বিষাক্ত হূলে মারা পড়তে লাগলো|অবশেষে ফিরোজ শাহ পরাজয় স্বীকার করে পিছু; হটলেন|মনে করা হয় দেবীর ইচ্ছাতেই মৌমাছির আক্রমণের স্বীকার হয়েছিলেন ফিরোজ শাহ|কিছু ঐতিহাসিকের মতে ঔরংজেবও এই মন্দির ধ্বংস করতে চেয়ে ব্যর্থ হন|শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিং এই মন্দিরে তাঁদের ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থসাহিব’ নিত্য পাঠ ও দেবীর পূজা করতেন । তিনি ১৮১৫ খ্রীঃ মন্দির সংস্কার করে এক ভব্য মন্দির নির্মাণ করেন|পরবর্তীতে মহারাজা রঞ্জিত সিং দেবীর মন্দিরের চূড়া শোনা দিয়ে বাধিয়ে দেন|

বর্তমানে প্রায় সারা বছরই এই মন্দিরে দর্শনার্থীদের ভীড় থাকে|মন্দিরের আশে পাশে প্রচুর ডালা কেনার দোকান দেখা যায়, যারা যাবেন, তারা মন্দিরের সংলগ্ন দোকান থেকেই নারিকেল, ধূপকাঠি, মোমবাতি, পূজো দেবার শুকনো ফল, সন্দেশ পাবেন । মন্দিরের তোরণদ্বার টি বিশাল। সেখানে শিল্পীর অদ্ভুত কারুকার্যের নিখুত ছোয়া লেগে আছে । দুপাশে দুটি বাঘের মূর্তি, এত সুন্দর মনে হয় যেনো জীবন্ত। বাঘ হল ভগবতীর বাহন । তাই মায়ের মন্দিরে মায়ের বাহন কেউ পূজা করা হয় । এর পর সূর্য কুন্ডের পাশ দিয়ে মন্দিরের দিকে যেতে হয় । সূর্য কুন্ড এক অপূর্ব দিব্য অলৌকিক কুন্ড। মানুষের বিশ্বাস এখানে স্নান করলে সর্ব পাপ নাশ হয় । তাই ভক্তেরা এখানে স্নান সেড়ে ভিক্ষুক দের দান ধ্যান করেন পুন্য লাভের আশায়।পাশেই ভগবান বিষ্ণুর পদচিহ্ন একটি মন্দিরে আছে, পরম শ্রদ্ধায় ভক্তেরা সেখানে ভগবান বিষ্ণুর শরণাগত হয় । মন্দির প্রাঙ্গনে রয়েছে রুদ্রকুন্ড, গোমুখী, ব্রহ্মকুন্ড নামক তিনটি কুণ্ড| রুদ্রকূন্ডর জল অনবরত ফোটে, তবে তাপমাত্রা কম। এই পবিত্র জল স্পর্শের জন্য দীর্ঘ লাইন দেখা যায়| প্রথা অনুসারে এই পীঠ দর্শন করে এখানে একটি অতি প্রাচীন ভগবান রামচন্দ্রের মন্দির দর্শন করতে হয় এবং অবশ্যই উন্মত্ত ভৈরবের দর্শনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ হয় এই তীর্থ যাত্রা |সব মিলিয়ে সারা বিশ্বের হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে অত্যান্ত প্রসিদ্ধ এই শক্তি পীঠ জ্বালামুখী|

আমাদের স্বশরীরে তীর্থ ভ্রমণ আপাতত পরিস্থিতির চাপে অনেকটাই ব্যাহত হচ্ছে তবে যারা একান্তই দেবী শক্তির আরাধনায় অংশগ্রহণ করতে চান তারা অবশ্যই নিজেদের যুক্ত করতে পারেন মা হৃদয়েশ্বরী সর্বমঙ্গলার মন্দিরের সাথে|প্রতিটি বিশেষ তিথিতে পূজা ও অঞ্জলি দেয়ার পাশাপাশি শাস্ত্রমতে গ্রহদোষ খণ্ডনের সু ব্যবস্থাও রয়েছে|এই সম্পর্কে বিশদে জানতে যোগাযোগ করতে পারেন আমার সাথে|দেখতে থাকুন আমার বিশেষ অনুষ্ঠানগুলি আর পড়তে থাকুন আমার এই আধ্যাত্মিক লেখালেখি|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|