Home Blog Page 9

বেড়ে জমিদার বাড়ির দূর্গা পুজো

বেড়ে জমিদার বাড়ির দূর্গা পুজো

 

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

 

আপাতত জেলার বিভিন্ন বিখ্যাত বনেদি বাড়ির পুজো গুলো নিয়ে লিখছি। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আজ বেড়ে জমিদার বাড়ির পুজো নিয়ে লিখবো।বর্ধমানের বেড়ে জমিদার বাড়ির দেড়শো বছরের পুরানো দুর্গাপুজো পুজোকে নিয়ে আছে অসংখ্য লোককথা এবং ঐতিহাসিক ঘটনা।

 

শোনা যায় এই বংশের দাপুটে জমিদার ব্রজেন্দ্রলাল দাসকে দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে

তার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পুজো করার কথা বলেন। আর সেই বছর থেকেই  বেড়ের জমিদার পরিবারে মা দুর্গার পুজো হচ্ছে মৃন্ময়ী মূর্তিতে। একচালার কাঠামোয় বসে থাকা দেবীর ডান পাশে বসে থাকেন দেবাদিদেব মহাদেব। শিব-পার্বতীর দুপাশে অধিষ্ঠাত্রী  লক্ষ্মী আর সরস্বতী । নিচে বসে কার্তিক আর গণেশ। দেবী এখানে মহিষাসুরমর্দিনী নন, দাস পরিবারে হয় হরগৌরীর আরাধনা।স্বপ্নাদেশ পাওয়ার আগে পর্যন্ত ঘটে পুজো হতো।

স্বপ্নে দেবী দেখা দেয়ার পর থেকে তাঁর রূপ বদলায়।

 

পুজো শুরু হওয়ার পরেই জমিদার ব্রজেন্দ্রলাল দাসের জীবনে ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা।

তার কোনও পুত্র সন্তান ছিল না।সবাই একরকম সন্তান লাভের আশা ছেড়েই দিয়ে ছিলেন সেই সময়ে দেবীর সেই স্বপ্নাদেশের পর মহাসমারোহে হরগৌরী মূর্তি তৈরি করে পুজোর শুরু হওয়ার পরই ব্রজেন্দ্রলাল দাস পুত্রলাভ করেন। দেবীর স্বপ্নাদেশে পাওয়া বলে একমাত্র পুত্রের নাম হয় দুর্গাচরণ দাস।

 

বেড়ে রাজবাড়ীর পুজোতে আসতেন বর্ধমানের মহারাজা সহ বহু গণ্য মান্য ব্যক্তি। সেই যুগে এই রাজবাড়ির পুজো ছিলো গোটা জেলার মধ্যে অন্যতম প্রসিদ্ধ পুজো।ঠাকুর দালানে নিয়ম

করে বসত যাত্রাপালা, গানের আসর। দুর্গামণ্ডপ লাগোয়া দোতলার ঘর থেকে অন্দরমহলের মহিলারা পুজো দেখতেন।

 

যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক কিছু পাল্টালেও আজও রীতি অনুসারে পঞ্চমীতে বোধনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু পুজো। সন্ধি পুজোয় আগে পশু বলী হলেও বর্তমানে এখানে শুধু

মণ্ডা বলি হয় নিয়ম রক্ষায় ।

 

একটি অলৌকিক ঘটনার কথা না বললেই নয় শোনা যায় সেই শুরুর দিন থেকে আজও এখানে অষ্টমীর দিন সন্ধিক্ষণে দুর্গামণ্ডপের উপর একটি শঙ্খচিল উড়তে দেখা যায়। আবার দশমীর দিন যখন দেবীর বিসর্জন করা হয় পাশের একটি প্রাচীন জলাশয়ে তখনও আকাশে উড়তে দেখা যায় সেই শঙ্খচিলটি।যুক্তি দিয়ে এই ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায়না তবে আস্থা অন্য বিষয়।

 

ফিরে আসবো বনেদি বাড়ির পূজোর পরের পর্ব নিয়ে। থাকবে এমন সব দূর্গা পূজোর ইতিহাস

এবং অলৌকিক ঘটনা। পড়তে থাকুন।

ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

বাহিন জমিদার বাড়ির দূর্গা পুজো

বাহিন জমিদার বাড়ির দূর্গা পুজো

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

একসময়ে উত্তর বঙ্গে দুর্গাপুজো বলতে কয়েকটি জমিদার বাড়ির পুজোকেই বোঝাতো। সেক্ষেত্রে উত্তর দিনাজপুরের বাহিন।জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো ছিলো অন্যতম পুজো।আজকের পর্বে এই বনেদি জমিদার বাড়ির পুজোর কথা জানাবো।

অবিভক্ত বাংলাদেশের দিনাজপুরের জমিদার ছিলেন রুদ্র প্রতাপ চৌধুরী।বাহিন নামক অঞ্চল থেকেই মূলত তার বিশাল জমিদারি পরিচালিত হতো।স্থানীয় ” নাগর ” নদীর ধার ঘেঁষে ছিল জমিদারের অট্টালিকা।জমিদার বাড়ির পাশেই বানানো হয়েছিলো সিংহবাহিনী মন্দির।সেখানেই প্রতিবছর দুর্গাপুজো হতো। আজও হয়।

আজও লোক মুখে শোনা যায় যে পূজোর সময়ে অতিথি দের অভ্যার্থনা জানাতে জমিদার বাড়ির সামনে বড় বাগানে বেশ কয়েকটি হাতি বাঁধা থাকত যা থেকে তাদের প্রতিপত্তি এবং বৈভব সহজেই অনুমান করা যায়।

বাহিনদের পারিবারিক দূর্গাপুজো ঠিক কত পুরনো তা সঠিকভাবে জানা যায় না। অনুমান করা হয় জমিদার বাড়ি নির্মাণ করার পরেই সেখানকার ঠাকুরদালানে দুর্গাপুজো শুরু হয়।এক সময়ে বাহিন জমিদার বাড়ির দূর্গোৎসবে বসত যাত্রাপালার আসর, থিয়েটার, সার্কাস ও বিশাল মেলা এবং পূজোর কদিন প্রজাদের জন্য সাতদিন ধরে ভুড়িভোজ আর আমোদপ্রমোদের আয়োজন হতো।

যুগের সাথে সাথে সব কিছুতেই বদল এসেছে আগে সিংহবাহিনী মন্দির চণ্ডীপাঠ ও দুর্গাপুজো করতেন জনা তিনেক পুরোহিত। তবে এখন আর সেসব আড়ম্বর নেই। জমিদারবাড়ির জৌলুসের সঙ্গে সেসব কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে।এখন বাহিন জমিদার বাড়ির দূর্গাপুজো তথাকথিত
পারিবারিক পুজো থেকে বারোয়ারী পূজোর রূপ নিয়েছে কারন সব এলাকা বাসি একত্রিত হয়ে এই শতাব্দী প্রাচীন দূর্গা পূজোর আয়োজন করেন।

তবে সেই সব জমিদারি রীতি নীতি না থাকলেও আজও এই দূর্গা পূজোর ক্ষেত্রে নিষ্ঠা এবং ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দেয়া হয়।

চলতে থাকবে জমিদার বাড়ির দূর্গা পুজো নিয়ে এই ধারাবাহিক আলোচনা।
আবার ফিরে আসবো এমনই একটি বনেদি
বাড়ির দূর্গা পুজোর কথা নিয়ে।
আগামী পর্বে।পড়তে থাকুন।
ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

শ্রীরামপুর রাজবাড়ির দূর্গা পুজো

শ্রীরামপুর রাজবাড়ির দূর্গা পুজো

 

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

 

হুগলী জেলার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রীরামপুর রাজবাড়ির দুর্গাপুজো। আজকের পর্বে এই পূজোর ইতিহাস নিয়ে লিখবো।

 

স্থানীয়দের কাছে এই বাড়ি গোস্বামী বাড়ি নামে পরিচিত।ইতিহাস বেশ পুরোনো এবং সমৃদ্ধ।বাংলার মসনদে যখন নবাব আলিবর্দি খান তখন এই জমিদারীর পত্তন হয়।রাজা রামগোবিন্দ গোস্বামী শ্রীরামপুর গোস্বামী পরিবারের আদিপুরুষ। তাঁর নাতি হরিনারায়ণ গোস্বামীর আমলে সূচনা হয় দুর্গাপুজোর। জানা যায়, ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয় শ্রীরামপুর রাজবাড়িতে।

 

জমিদার বাড়িতে বসতবাড়ির অনুকরণে নির্মিত প্রাসাদ সংলগ্ন ঠাকুরদালানে শুরু হয় দুর্গাপুজো। এখানে একচালার মধ্যে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে মা দুর্গার সাথে থাকেন কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী এবং সরস্বতী ঠাকুর। প্রতিমা সজ্জিত হয় ডাকের সাজে।

 

জানা যায় এই রাজবাড়িতে দুর্গাপুজোয় আসর জমিয়ে গিয়েছেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি এবং ভোলা ময়রা যাদের কবিগান ছিলো সে যুগে বিখ্যাত যা নিয়ে পরবর্তীতে সিনেমাও হয়েছে।এই বাড়িতে এসেছেন গান্ধীজি, বিধান রায় এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মতো মনীষীগণ।

 

শুরু থেকেই এই রাজবাড়িতে বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। রথের দিন কাঠামো পুজো হয়। তারপর একচালার প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়ে যায়। মায়ের ডাকের সাজ আজও বর্ধমানের পূর্বস্থলী থেকে নিয়ে আসা হয়। অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় এখনও পুরনো আমলের পিতলের ১৩৮টি প্রদীপ জ্বালানো হয়। দশমীর দিন বাড়ির মহিলারা ঠাকুর দালানের বাইরে মাছ ও পান খেয়ে মাকে বরণ করার পর শুরু হয় প্রতিমা নিরঞ্জনের প্রস্তুতি। শ্রীরামপুর রাজবাড়ি ঘাটেই করা হয় প্রতিমা বিসর্জন।

 

বনেদি বাড়ির পূজোর পরের পর্ব নিয়ে

ফিরে আসবো যথা সময়ে। থাকবে অন্য একটি দূর্গাপূজো নিয়ে অনেক এমন তথ্য থাকবে এমন অনেক ইতিহাস। পড়তে থাকুন।

ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

বাঁকুড়ার জমিদার বাড়ির দূর্গা পুজো

বাঁকুড়ার জমিদার বাড়ির দূর্গা পুজো

 

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

 

বাংলার প্রাচীন রাজবাড়ী বা জমিদার বাড়িরপুজো মণ্ডপ গুলি বা বনেদি বাড়ির পুজো নিয়ে ধারাবাহিক লিখছি । আজকের পর্বের বিষয়

বাঁকুড়ার প্রসিদ্ধ রায় চৌধুরী বাড়ির পুজো।

 

গ্রামের নাম দামোদরবাটি জমিদার দামোদর নারায়ণ চৌধুরী এর নাম অনুসারেই গ্রামের নামকরণ হয়।কথিত আছে চৌধুরী পরিবারের আদি পুরুষ তৈলক্যনাথ গুহ বাংলাদেশের যশোরের জমিদার ছিলেন। বর্গিদের হাত থেকে বাঁচতে যশোর ছেড়ে হাজির হয়েছিলেন মল্লগড় বিষ্ণুপুরে। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা আশ্রয় দিয়েছিল ওই জমিদারকে। পরবর্তীকালে রায় চৌধুরী উপাধি দেন মল্ল রাজারা। মল্লরাজাদের সৌজন্যে আর্থিক ভাবে চৌধুরী জমিদাররা সমৃদ্ধি লাভ করে।দামোদরবাটিতে নতুন করে তৈরি হয় প্রাসাদ।

শুরু হয় দুর্গাপুজো।বাঁকুড়ার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এই পুজো প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের প্রাচীন।

 

সেকালে জমিদাররা বড়ো দীঘি বা পুকুর খনন করতো জলের সমস্যা দূর করতে।একবার পুকুর ক্ষণনের সময় ঘটেএক অলৌকিক ঘটনা।

শোনা যায় গ্রামের বড়পুকুর খননের সময় নিম কাঠের দুর্গার দ্বিভুজা মাতৃ মূর্তি উদ্ধার করেন চৌধুরী পরিবারের এক বংশধর। মনে করা হয় এই ঘটনাকে দেবীর আদেশ হিসেবেই দেখে ছিলেন চৌধুরী পরিবার।তারপর থেকেই চৌধুরী পরিবারে ঘটা করে শুরু হয় দুর্গাপুজা।

 

দূর্গা পূজোর সময়ে আজও জমিদার বাড়ির দুর্গা দালানে বেজে ওঠে নহবতের সুর মুর্ছনা। এখানের প্রতিমা একটু অন্যধরনের। এখানে নিমকাঠের দেবী দুর্গা দ্বিভুজা। উপরে মহাদেব। দেবীর পাশে কার্তিক, গনেশ, লক্ষী স্বরসতী। মল্লরাজাদের মৃন্ময়ীর কাঠামো অনুরুপ চৌধুরী জমিদার বাড়ির দুর্গা। বৈষ্ণব মতে পুজো হয়।প্রাচীন তালাপাতার চন্ডী পাঠ করা হয় জমিদার বাড়ির দুর্গাদালানে।

সব মিলিয়ে ঐতিহ্য এবং আধ্যাত্মিকতার এক সম্মিলিত রূপ এই বনেদি বাড়ির দূর্গা পুজো।

 

ফিরে আসবো আগামী পর্বে অন্য কোনো বনেদি বাড়ির দূর্গাপুজো নিয়ে। পড়তে থাকুন।

ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

সাবর্ন রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো

সাবর্ন রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো

 

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

 

তিলোত্তমা কলকাতার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায় একটি পরিবারের কথা না বললে। সেই পরিবার হলো সাবর্ন চৌধুরী পরিবার। একাধিক ইতিহাসকার মনে করেন এই কলকাতার দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন এই বংশের আদি পুরুষ লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়।আজকের পর্বে এই বাড়ির দূর্গাপুজো নিয়ে আলোচনা করবো।

 

মোঘল আমলে সাবর্ণ গোত্রীয় জমিদার লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় সেনাপতি মানসিংহের কাছ থেকে পেলেন আটখানি পরগণার জমিদারি সত্ত্ব। তারপর তার আর্থিক উন্নতি ও সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়লো ধূমকেতুর গতিতে।

 

আগে হালিশহরের বাড়িতে পুজো হতো পরবর্তীতে জমিদার লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার বরিশায় এক প্রকান্ড প্রাসাদ বানালেন। সেখানে তৈরী হলো চণ্ডীমণ্ডপ। সেই সুবিশাল চন্ডী মণ্ডপে শুরু করলেন দেবীদুর্গার আরাধনা।

 

প্রায় চারশো বছর ধরে চলে আসছে সাবর্ন রায় চৌধুরীদের দুর্গাপূজা।তবে কালের নিয়মে অনেক পরিবর্তন এসেছে। পরিবারের সদস্যর পরবর্তীতে ছড়িয়ে পরেন বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। আলাদা আলাদা করে তারা দূর্গা পুজো শুরু করেন।

 

বর্তমানে কলকাতা ও কলকাতা সংলগ্ন এলাকায় সাবর্ণদের আটটি বাড়িতে আটটি দুর্গাপুজো হয়। যার মধ্যে বড়িশায় ছয়টি বাড়ির পাশাপাশি একটি বিরাটির বাড়ি ও একটি নিমতার বাড়িতে

পুজো হয়।

 

আটটি বাড়িতে দেবীর গায়ের রঙ হয় স্বর্ণবর্ণা। আজও এই বাড়ির পুজোয় বিভিন্ন প্রাচীন গয়না দিয়ে সাজানো হয় দেবীকে এবং জন্মাষ্টমীতে কাঠামোপুজো হয় এবং কৃষ্ণানবমীতিথিতে বোধন হয়।বিদ্যাপতি রচিত ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’ মতেই পুজো হয় আটটি বাড়িতে।

 

এই পরিবারের ইতিহাস থেকে জানা যায় সুদূর অতীতে পশুবলিপ্রথা থাকলেও বর্তমানে সেই প্রথা বন্ধ রয়েছে।বাকি বাড়ি গুলিতে বাড়িতে আমিষভোগ হলেও নিমতার বাড়িতে নিরামিষভোগ হয়।

 

আজকের এই পর্ব এখানেই শেষ করলাম|

ফিরবো আগামী পর্বে|বনেদি বাড়ির দূর্গা পূজোর আগামী পর্ব নিয়ে। পড়তে থাকুন।ভালো থাকুন।

ধন্যবাদ।

চাঁচল রাজবাড়ির দূর্গা পুজো 

চাঁচল রাজবাড়ির দূর্গা পুজো

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

শুধু কলকাতা বা দক্ষিণ বঙ্গের পুজো নয় উত্তর বঙ্গেও এমন অনেক বনেদি বাড়ির পুজো আছে যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।আজ আলোচনা করবো মালদার চাঁচল রাজ বাড়ির পুজো নিয়ে।

সতেরো শতকের শেষভাগ। সেই সময় উত্তর মালদহের বিস্তীর্ণ এলাকার রাজা ছিলেন রামচন্দ্র রায়চৌধুরি। প্রজাদরদী এবং ধর্মপ্রাণ রাজা ছিলেন তিনি। শোনা যায় একবার রাজা দেবী চণ্ডীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মহানন্দার ঘাটে স্নান করতে যান। সেই সময় তাঁর হাতে অলৌকিক ভাবে চতুর্ভুজা অষ্টধাতুনির্মিত মূর্তি উঠে আসে। দেবী চণ্ডীর অষ্টধাতুর মূর্তি মহানন্দার ঘাট থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে রাজবাড়িতে এনে তিনি

প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেদিন থেকেই রাজবাড়িতে শুরু হয় দেবীর নিত্যপুজো।

সেই সময় থেকেই প্রতিবছর চাঁচল রাজবাড়িতে বেশ ধুমধাম করে দুর্গাপুজো শুরু হয়। পরবর্তীকালে পুজোর জন্য পাকা মন্দির নির্মাণের করেন রাজা । মন্দির তৈরির পর রাজা রামচন্দ্র দুর্গাপুজোর জন্য সেই সময় বেশ প্রায় সাত হাজার টাকাও বছরে বরাদ্দ করেন।শুরু হয় ধুমাধাম করে দূর্গা পুজো।

সেই রাজা নেই সেই রাজ্যপাটও নেই। চাঁচল রাজবাড়িতে এখন স্থাপিত হয়েছে কলেজ, মহকুমা প্রশাসনিক ভবন, আদালত-সহ একাধিক সরকারি দপ্তর। তবে রাজবাড়ির একাংশে থাকা ঠাকুরবাড়ি এখনও আগের মতোই রয়ে গিয়েছে।পুজোও হয়।

দূর্গা পূজা উপলক্ষে বাড়ির সদস্যরা একত্রিত হয়।

সেই জৌলুস হয়তো নেই। তবে নিষ্ঠা সহকারে আজও দেবী এখানে পূজিতা হন। নিয়ম করে প্রতিটি শাস্ত্রীয় রীতি নীতি আজও পালিত হয়।

আজও প্রাচীন প্রথা মেনে সপ্তমী তিথিতে রাজবাড়ি থেকে দুর্গাদালানে নিয়ে আসা হয় অষ্টধাতুর চতুর্ভুজা মা চণ্ডীকে। দশমীতে তিনি ফের রাজবাড়িতে ফিরে যান। এখানে সতের দিন

ধরে উৎসব পালিত হয় দূর্গাপূজা উপলক্ষে

চাঁচল রাজ বাড়ির এই পুজো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অদ্ভুত নিদর্শন। এখানে বিসর্জনের সময় মহানন্দার নদীর ধরে বৈরগাছি

নামক এলাকার মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ লণ্ঠন নিয়ে মাকে পথ দেখান।এই রীতি শুরুর দিন

থেকে আজও প্রচলিত আছে।

আসন্ন দূর্গা পুজো উপলক্ষে চলতে থাকবে এই সব ঐতিহাসিক রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়ির পুজো গুলি নিয়ে আলোচনা। ফিরে আসবো

আগামী পর্বে। পড়তে থাকুন।

ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

শেওড়াফুলি রাজবাড়ির দূর্গা পুজো

শেওড়াফুলি রাজবাড়ির দূর্গা পুজো
পন্ডিত ভৃগুশ্রী জাতক
বাংলার প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক পুজো গুলির কথা বলতে হলে শুধু কলকাতার বনেদি পুজো গুলোর কথা বললে হয়না। জেলার পুজো গুলির কথাও বলতে হয়। এমনই এক পুজো শেওড়াফুলি রাজবাড়ির ঐতিহাসিক পুজো। আজকের পর্বে এই পুজোর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও একটি অলৌকিক ঘটনার কথা বলবো।
শোনা যায় বর্ধমানের নারায়ণপুরে রাজত্ব করতেন এই বংশের আদি পুরুষরা। মোঘল আমলে স্বয়ং সম্রাট আকবর নাকি তাদের জমি দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে নদী ভাঙন গ্রাস করেছিল জমিদারি। ভিটে মাটি হারিয়ে বাধ্য হয়ে পরিবার নিয়ে শেওড়াফুলি এসে বসবাস করতে শুরু করেন তৎকালীন জমিদার।
বর্ধমানে যখন এই জমিদার বংশের গৌরব ময় সময় চলছে তখন গ্রামে পুকুর খনন করার সময় স্বপ্নাদেশ পান জমিদার মশাই । স্বপ্নাদেশ অনুসারে মাটির তলা থেকে পান দেবী দশভূজার অষ্টধাতুর মূর্তি।
পরবর্তীতে শেওড়াফুলির বাড়িতে এসে গৃহ মন্দিরে দেবী দশভূজার মূর্তিকে দেবী সর্বমঙ্গলা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় তিনশো বছর ধরে সেই প্রতিষ্ঠিত মূর্তিতেই চলে আসছে পুজো । নিত্যপূজা হয় কিন্তু শরতের আকাল বোধন ও বসন্তকালের বাসন্তী পুজো এই মন্দিরের প্রধান উৎসব।
অর্থাৎ দূর্গা রূপেই তারা তাদের আরাধ্যা দেবীর আহ্বান করেন।
আজও অমলিন আছে এই পুজোর গৌরব। বজায় আছে সব সেকালের রীতি নীতি এবং উপাচার যেমনটা বেশিভাগ রাজ বাড়ি বা জমিদার বাড়িতেই চলছে।
বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের বনেদি বাড়িগুলির আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আপনাদের জানাবো। আগামী পর্ব গুলিতে পড়তে থাকুন।
ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

কাশীপুর রাজ বাড়ির দূর্গা পুজো

কাশীপুর রাজ বাড়ির দূর্গা পুজো
পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক
এক কালে যখন দূর্গা পুজো মূলত রাজ বাড়ি গুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো তখন জাঁকজমকে মাঝে মাঝেই কলকাতার পুজো গুলোকে টেক্কা দিতো কিছু জেলার পুজো।এমনই এক ঐতিহাসিক পুজো পুরুলিয়া জেলার কাশীপুর রাজবাড়ির পূজো যা নিয়ে আজকের পর্ব।
আগে এই পরিবারের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে রাখা প্রয়োজন।কাশীপুর রাজপরিবার আসলে পঞ্চকোট রাজবংশের শেষ একটা রাজপরিবার। কয়েকশ বছর আগে পঞ্চকোট পাহাড়ের পাদদেশে এই রাজবংশ বসবাস করত। সেখান থেকে বর্গিরাজাদের আক্রমণের পর কাশীপুরের যিনি মহারাজা ছিলেন উনি রঘুনাথপুর পালিয়ে আসেন সপরিবারে; এবং তারপর থেকে এখানেই অর্থাৎ পুরুলিয়ার কাশিপুরে পুরোপুরি ভাবে অবস্থান করেন। তারপর ধীরে ধীরে উনি ওনার সাম্রাজ্য বিস্তার করেন ও কাশীপুরের এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন ও সপরিবারে বসবাস শুরু করেন। দুর্গাপূজার প্রচলন করেন যা আজও অব্যাহত।
এই কাশীপুর রাজ বাড়ির দূর্গাপূজোর কিছু বিশেষত্ব আছে।এখানে দেবী পূজো তথা প্রতিটি শাস্ত্রীয় উপাচার পালিত হয় ঘড়ির কাঁটা ধরে।
এক মুহূর্তের হের ফের হয়না।যেহেতু বৈষ্ণব মতে হয়ে থাকে পূজোর যাবতীয় আয়োজন থেকে প্রাণী হত্যা সম্পূর্ণ বাদ তার বদলে পূজো কদিন মায়ের অন্নভোগ দেওয়া হয়।
এই কাশী পুর রাজবাড়ির দূর্গা পুজো নিয়ে একটি অলৌকিক ঘটনাও কিংবদন্তী রূপে প্রচলিত আছে।পূজোর অষ্টমী তিথিতে নিশিপূজোর সময় সিঁদুরের থালার মধ্যে মায়ের পায়ের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। সেই সময়টাতে ঠাকুর দালান ভারী পর্দা দিয়ে আচ্ছাদন করে দেওয়া হয় এবং সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। শুধু সেই সময়টুকু গোপনীয়তা বজায় রাখতে এমন টা করা হয়।
এক সময়ে পারিবারিক পুজো হিসেবে শুরু হলেও বর্তমানে এই জেলার অসংখ্য মানুষ এই পুজোয় অংশ নেন। পুজো কদিন রাজবাড়ির সদর দরজা থেকে ঠাকুর দালান বা প্রাঙ্গন সর্বত্র থাকে মানুষজনের অবাধ আনাগোনা।
আসন্ন দূর্গা পুজো উপলক্ষে সারা বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন সব ঐতিহাসিক দূর্গা পূজো নিয়ে চলতে থাকবে এই ধারাবাহিক অনুষ্ঠানে।
ফিরে আসবো আগামী পর্বে। পড়তে থাকুন।
ভালো থাকুন ধন্যবাদ।

শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা

শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

ভারতের প্রাচীন গুরু শিষ্য পরম্পরার দেশ। আমরা বিশ্বাস করি একজন মানুষের সফতার পেছনে শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন আদর্শ শিক্ষক কেবলমাত্র পড়াশোনার ক্ষেত্রে নয়, তিনি ছাত্রকে জীবনে চলার পথে পরামর্শ দেবেন, ব্যর্থতায় পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দেবেন, সাফল্যের দিনে নতুন লক্ষ্য স্থির করে দেবেন। তিনি তাকে শুধুমাত্র জীবনে সফল হওয়া নয়, কিভাবে একজন ভাল মানুষ হতে হয় শেখাবেন।

সমাজে শিক্ষকদের ভূমিকায় সম্পর্কে শ্রদ্ধেয়
এ পি জে আবদুল কালাম বলেছিলেন, ‘যদি একটি দেশকে বা জাতীতে দুর্নীতিমুক্ত এবং উন্নত হতে হয়, তাহলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এ ক্ষেত্রে তিনজনের ভূমিকা সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তারা হলেন বাবা, মা এবং শিক্ষক।’
খুবই বাস্তব উপলব্ধি এ নিয়ে সংশয়ের নেই।

তবে আজকের এই শিক্ষক দিবসের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আছে।শিক্ষাবিদ ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তার গুণমুগ্ধ ছাত্র ও বন্ধুরা তাঁর জন্মদিন পালন করতে চাইলে তিনি বলেন ‘জন্মদিনের পরিবর্তে ৫ই সেপ্টেম্বর যদি শিক্ষক দিবস উদ্‌যাপিত হয় তবে আমি বিশেষরূপে অনুগ্রহ লাভ করবো।’
সেই শুরু। সেই থেকে আজও এই দিনটি
শিক্ষক দিবস রূপে পালিত হয়।

আজ জাতীয় শিক্ষক দিবস এবং আদর্শ
শিক্ষক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন।
সকল শিক্ষককে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা এবং
শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা।

আঢ্য বাড়ির দূর্গা পুজো

আঢ্য বাড়ির দূর্গা পুজো
পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক
আজকের বনেদিবাড়ির দূর্গাপুজোর এই পর্বের সাথে এই ছড়ার সম্পর্ক আছে।আজ আলোচনা করবো চুঁচুড়ার আঢ্য বাড়ির পুজো নিয়ে যা প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো একটি বিখ্যাত পুজো।
এই পরিবারের একজন অন্যতম প্রাণপুরুষ, ছিলেন যোগীন্দ্রলাল আঢ্য ওরফে যগু মাস্টার।
যখন বাংলায় প্রথম রেলগাড়ি চলতে শুরু হয়
সেই সময় হুগলি স্টেশনের স্টেশন মাস্টার ছিলেন যগুবাবু। তার হাত ধরেই এই পুজোর সূচনা। তারপর থেকে বংশানুক্রমে আঢ্য বাড়িতে হয়ে আসছে পুজো আজও চলছে সেই পুজো।
এখানে প্রতিমা শিল্পী থেকে শুরু করে পুরোহিত, রান্নার বামুন ঠাকুর প্রত্যেকেই বংশানুক্রমিকভাবে যুক্ত রয়েছেন আঢ্য বাড়ির পুজোর সঙ্গে। কুমারী পুজোতে যে মেয়েটি বর্তমানে পূজিতা হয়, সেও প্রথম যুগের কুমারী মেয়েটির বংশেরই কন্যা।
আঢ্য বাড়িতে দেবী দূর্গা দশভুজা নন তিনি দ্বিভুজা। তিনি এখানে শিবের কোলে অধিষ্ঠাতা। তবে শিবদুর্গার সঙ্গে তাদের পুত্র কন্যারাও থাকেন।
আঢ্য বাড়িতে বৈষ্ণব মতে পুজো হয় তবে কুমারীপুজো, যজ্ঞ এবং চণ্ডীপাঠ পালন করা হয় শাক্ত মতে। এই বাড়ির পুজোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য মিষ্টি৷ পুজোর ফলমূল আর মিষ্টি পরিবেশন করা হয় কাঠের বিশাল তেপায়াতে করে।সেই পাত্রের নাম লটকান।
আঢ্য বাড়িতে মহালয়ার দিন থেকেই প্রতি সদস্য নিরামিষ আহার করেন। দশমীর দিন পুজো শেষে বাড়ির বিবাহিত মহিলারা আরশিতে মায়ের প্রতিবিম্ব দেখার পর খাওয়া হয় আমিষ ।
সুদূর অতীতে এই পরিবারে কাঙালি ভোজন এবং বিদায়ের রেওয়াজ ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে আসতেন প্রচুর দরিদ্র মানুষ। এলাহী আয়োজন থাকতো তাদের জন্য। বর্তমানে সেই প্রথা নেই।
তবে বাকি সব রীতি নীতি আজও মানা হয়।
বনেদি বাড়ির দূর্গা পূজোর পরের পর্ব নিয়ে
ফিরে আসবো যথা সময়ে। থাকবে অন্য কোনো বনেদি বাড়ির দূর্গাপূজোর কথা। পড়তে থাকুন।
ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।