কালী কথা – সিঙ্গুরের ডাকাত কালী

16

কালী কথা – সিঙ্গুরের ডাকাত কালী

 

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

 

এককালে হুগলি ছিলো ডাকাতদের জন্য বিখ্যাত। এই জেলার সিঙ্গুরের কাছেই আছে এক প্রাচীন ডাকাত কালীমন্দির যেখানে এককালে ডাকাতদের দ্বারাই পূজিতা হতেন দেবী।আজকের কালী কথায় এই ডাকাত কালীর কথাই জানাবো।

 

প্রাচীন সরস্বতী নদীর তীরে অবস্থিত সিঙ্গুর এককালে বেশ সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। তার আদি নাম ছিল সিংহপুর। এখানে রাজত্ব করতেন মহারাজা সিংহবাহু। তাঁর নামানুসারেই রাজধানীর নাম হয় সিংহপুর যা পরবর্তীতে লোক মুখে বিকৃত হয়ে সিঙ্গুর হয়।

 

সিঙ্গুরের ডাকাত কালীমন্দির সুপ্রাচীন তাতে সন্দেহ নেই। ডাকাতদের প্রতিষ্ঠিত পুজো বলেই মায়ের নাম ডাকাত কালী। এই মন্দিরে ডাকাত সনাতন বাগদি ডাকাত কালী পুজো করতেন। মনে করা হয় প্রাচীন ডাকাতকালী মন্দিরের তিনিই ছিলেন শেষ সেবক। তাঁর মৃত্যুর পরে পরেই এই মন্দিরের নিত্যপুজো বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে রঘু ও গগন ডাকাত ঘট স্থাপন করে আবার সেই মন্দির চত্তরে মা কালীর পুজো শুরু করেছিলেন।

 

নিয়মিত শ্যামা মায়ের পুজো দিত তারা। কালী পুজো দিয়ে তবেই বের হত ডাকাতি করতে। খুনজখম লুঠতরাজ শেষে ফিরে এসে ডাকাতি করা সামগ্রী সব অর্পণ করত মায়ের চরণে। সেই সেই সময়ে তন্ত্রমতে পুজো হত মায়ের। হত নরবলিও যা নিয়ে এলাকায় অনেক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে।

 

এখনো স্থানীয়রা এই ডাকাত কালীকে এতটাই জাগ্রত মনে করেন যে মন্দিরের নিত্যপুজো ছাড়া আশেপাশের তিনটি গ্রামে আর কোনও কালীমূর্তির পুজো হয় না। মূর্তি তো দূরের কথা, গ্রামের কোনও বাড়িতে মা কালীর ছবি লাগানো ক্যালেন্ডারও টাঙায় না কেউ।

 

সনাতন ডাকাত গোষ্ঠী দ্বন্দে মারা যাওয়ার পর কিছুকাল পুজো বন্ধ থাকে পরবর্তীতে আবার মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় এবং পুজো শুরু হয় মায়ের স্বপ্নাদেশে। কোনও এক সময় পাশের গ্রামের এক অবস্থাপন্ন গৃহস্থ চাষের সামগ্রী নিয়ে বেচাকেনার জন্য শেওড়াফুলি হাটে যাচ্ছিলেন। গরুর পিঠে শস্য বোঝাই করে সিঙ্গুরের ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে গাছের ছায়ায় বসে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। ঘুমের মধ্যেই মা ডাকাত কালী তাঁকে স্বপ্ন দেন বাড়ি ফিরে যেতে এবং ওই স্থানে তাঁর মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে।তিনি বাড়ি ফিরে গিয়ে গ্রামের সবাইকে ডেকে ঘটনাটি বলেন। যে শস্যের বস্তা বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তিনি

সেই বস্তায় সোনার মোহর পাওয়া যায়। তা দিয়েই দেবীর ইচ্ছানুসারে তৈরি করা হয় একচালার ছোট মন্দির। এই ঘটনার কিছুকাল পরে বর্ধমানের রাজাকে মা স্বপ্ন দেন বড় মন্দির গড়ে পুজোর ব্যবস্থা করতে। স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুজোর জন্য জমি দান করেন বর্ধমানের রাজা। সেবাইত রেখে দেবীর নিত্যপূজার ব্যবস্থা করা হয়। সেই সেবাইতের বংশধরেরা এখনও পুজো চালিয়ে যাচ্ছেন।

 

প্রাচীনকালে টেরাকোটার কাজ থাকলেও আজ তা বিলুপ্তপ্রায়। মন্দিরের সামনে রয়েছে নাটমন্দির। তবে এই মন্দিরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় গর্ভগৃহের কাঁঠাল কাঠের তৈরি দরজাটি। কারুশিল্পের সুন্দর নিদর্শন এই প্রাচীন দরজা।

প্রসঙ্গত বলে রাখি এইস্থানেই ডাকাতদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন মা সারদা এবং তার স্বরূপ বুঝতে পেরে ডাকাতরা তাকে স্বসম্মানে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেন।

 

ফিরে আসবো কালী কথার পরবর্তী পর্বে। থাকবে বাংলার অন্য এক ঐতিহাসিক কালী পুজো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।পড়তে থাকুন।

ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।