বর্তমানে যে তারাপীঠ মন্দির বাংলার তন্ত্র সাধনার পীঠস্থান হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তার ইতিহাস কিন্তু বহু প্রাচীন এবং নানা দিক দিয়ে বেশ রহস্যময়। মূলত দুভাবে এই মন্দিরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে ব্যাখ্যা করা যায় এক পুরাণ এবং লোককথা।সেদিক দিয়ে এই মন্দির হাজার বছর পুরোনো আবার বর্তমান মন্দিরের স্থাপত্যর বিচারে বা বামা নাটোর রাজপরিবার এবং ক্ষেপার সময় কাল থেকে ধরলে কয়েকশো বছরের ইতিহাস।শুরু করবো জয়দত্ত সদাগরের কথা দিয়ে ।আজ থেকে প্রায় আটশো বছর আগের ঘটনা। তিনি ছিলেন বীরভূমের রত্নাগড় নিবাসী। একবার তিনি বাণিজ্যে প্রভূত সম্পদ, অর্থ লাভ করে বাড়ি ফিরছিলেন। চলার পথে অসুস্থতায় মৃত্যু হল তাঁর সঙ্গে থাকা প্ৰিয় পুত্রের। বাড়ি ফিরেই ছেলের অন্ত্যেষ্টি করবেন স্থির করে তিনি মাঝিদের বললেন, পুত্রের দেহটাকে ভালো করে সংরক্ষণ করে রাখতে।এদিকে সন্ধ্যা নেমেছে। রাত্রিটা তাই পথেই বিশ্রাম নিতে হবে। চলতে চলতে থামলেন এক বিশাল জঙ্গলের পাশে। স্থানটির নাম চণ্ডীপুর।নিদ্রাহীন জয় দত্ত তখন মৃত ছেলের দেহ আঁকড়ে রাত জাগছেন। সেই সময় এক কুমারী মেয়ে নৌকার কাছে এসে দাঁড়ালেন। দেখা গেলো রাত্তির আকাশজুড়ে অপূর্ব এক জ্যোতি। অপূর্ব সুন্দরী সেই মেয়েটি জয়দত্তকে জিজ্ঞাসা করলেন,‘ও বাছা, এত নৌকা ভরে কী নিয়ে চলেছো গো?’ পুত্রশোকে জয়দত্তের মন ভারাক্রান্ত ছিল। তাই তিনি রাগত স্বরে মেয়েটিকে বললেন, ‘ছাই আছে’। সে কথা শুনে মেয়েটি ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে জয়দত্ত দেখলেন তাঁর নৌকার সব বাণিজ্যসামগ্রী, অর্থ ছাইতে পরিণত হয়েছে। পরদিন সকালে মাঝিরা রান্নায় বসল। খেয়েদেয়ে নৌকা নিয়ে যাত্রা করতে হবে। কাটা শোল মাছ কাছেই এক কুণ্ডের জলে ধুতে গেল তারা। কী আশ্চর্য! জলের স্পর্শ পেয়ে মাছটি জ্যান্ত হয়ে সাঁতরে চলে গেল। মাঝিরা দৌড়ে এসে জয়দত্তকে সব কথা জানাল। জয়দত্তের মনে পড়ল আগের রাতের সেই মেয়েটির কথা। তিনি বুঝতে পারলেন কোনো দেবী এসেছিলেন তার কাছে। অজ্ঞানতা বসত তিনি বুঝতে পারেননি।সেই রাতে দেবী তারা স্বপ্নে দেখা দিলেন এবং বললেন কুণ্ডের জল ছেলের গায়ে ছড়ালেই সে বেঁচে উঠবে। পরদিন বশিষ্ঠকুণ্ডের জল ছেলের গায়ে ছেটাতেই ছেলে ‘তারা তারা’ বলে বেঁচে উঠল সে। শুধু তাই নয় তিনি হারানো সম্পদও ফিরে পেলেন। সেদিন রাতে বী তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দিলেন। তাঁকে আদেশ করে বললেন যে এই জঙ্গলের মধ্যে একটা শ্বেতশিমুল গাছের নীচে একটা শিলাবিগ্রহ রয়েছে। সেই বিগ্রহ একটা মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে তার পুজোর ব্যবস্থা করবি। আমি হলাম উগ্রতারা। জঙ্গলের মধ্যে শ্মশানে আমার বাস।’ পরদিন সকালে জয় দত্ত আদেশ অনুসারে জঙ্গলে খুঁজে খুঁজে শ্বেতশিমুল গাছের নীচ থেকে শিলাবিগ্রহ আবিষ্কার করলেন এবং তার কাছেই পেলেন চন্দ্রচূড় শিবের মূর্তি। বশিষ্ঠকুণ্ড বা জীবিতকুণ্ডের সামনে তাড়াতাড়ি মন্দির নির্মাণ করে সেই শিলামূর্তি ও চন্দ্রচূড় শিবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন এবং কাছেই মহুলা গ্রামের এক ব্রাহ্মণকে নিত্যপূজার দায়িত্ব দিয়ে বিদায় নেন।এই ছিলো তারাপীঠ মন্দির সৃষ্টির ইতিহাস।সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।আবার শাস্ত্র মতে এখানে সতীর ঊর্ধ্ব নয়নতারা বা প্রজ্ঞানয়ন পড়েছিল।শুধু তাই নয় সতীহারা শিব দেবীকে কামনা করে এখানে এসে সাধনা করেন। তিন লক্ষ জপ করেছিলেন। তাঁর সাধনায় তুষ্ট হয়ে তারা বলেছিলেন, তিনি আবার উমারূপে তাঁর কাছে স্ত্রী রূপে যাবেন। বশিষ্ঠ ঋষি বিষ্ণুর দ্বারা আদিষ্ট হয়ে তারা পীঠের সেই স্বেত শিমুল গাছের নিচে বসে সাধনা করেছিলেন।এবং সিদ্ধি লাভ করে ছিলেন।সমুদ্র মন্থনে ওঠা বিষ ওপান করে মহাদেব যখন নীলকণ্ঠ তখন ‘দেবী তারা’ শিবকে আপন সন্তানের মতো কোলে নিয়ে আপন স্তন্য থেকে অমৃত পান করান সেই অমৃত পান করে শিবের বিষজ্বালা দূর হল। সেই থেকে দেবীর নাম হল তারিণী। তিনি শিবকে তারণ করেছেন। এই বিশ্বকেও তিনি তারণ করেন।সেই তারিণী থেকেই তারা নামের সৃষ্টি।পরবর্তীতে সাধক বামা ক্ষেপা থেকে সাধক কমলা কান্ত সবার ও অন্যতম প্ৰিয় সাধন স্থল ছিলো এই তারাপীঠ। বামা ক্ষেপা তো তার সারাটা জীবনই কাটিয়েছেন এই তারা পীঠ মহাশ্মশানে। সেই সময় দেশ বিদেশ থেকে বহু বিখ্যাত মানুষ তারাপিঠে আসতেন শুধু একবার এই মাতৃ মন্দির দর্শন করতে এবং বামা ক্ষেপার আশীর্বাদ পেতে। সেই পরম্পরা অবশ্য আজও চলছে। যদিও দ্বারকা নদী দিয়ে বহু জল প্রবাহিত হয়েছে। আজ বামা ক্ষেপাও নেই সশরীরে তবু মানুষের আস্থা আছে। ভক্তি আছে। আর আছে তারাপীঠের সমৃদ্ধ ইতিহাস।ফিরে আসবো আগামী পর্বে এমনই কোনো অজানা রহস্যময় আধ্যাত্মিক স্থানের ইতিহাস নিয়ে। পড়তে থাকুন।ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।