বিশেষ পর্ব – জ্ঞান গঞ্জ রহস্য

311

আজ লিখবো রহস্যময় জ্ঞানগঞ্জ নিয়ে যার কথা প্রথম লোকসমক্ষে আসে১৯৩৩ সালে জেমস্ হিলটনের লেখা বিখ্যাতবই ‘লষ্ট হরাইজন’ এর মাধ্যমে ৷ এই জ্ঞান গঞ্জ শ্যঙ্গড়ী-ল্যা বা সাম্বালা উপত্যকা নামেও খ্যাতজ্ঞানগঞ্জ হল হিমালয়ের দুর্গম স্থানে লুকিয়ে থাকা এক রহস্যময় নগররাষ্ট্র। তিব্বতে এই নগররাষ্ট্রটিকে বলা হয়ে শাম্বালা। ভারতে বলা হয় জ্ঞানগঞ্জ বা সিদ্ধাশ্রম। এই নগররাষ্ট্রে প্রবেশ করার অধিকার সাধারণ মানুষের নেই। কারণ জ্ঞানগঞ্জ হল অমরলোক। এখানে কারও মৃত্যু হয় না। চেতনা এখানে সদা জাগ্রত থাকে।হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের উচ্চকোটির যোগী, সাধু, ঋষি, মুনি ও সিদ্ধপুরুষরাই কেবলমাত্র জ্ঞানগঞ্জে বাস করার আমন্ত্রণ পান। তবে সিদ্ধপুরুষ হলেই জ্ঞানগঞ্জে প্রবেশের অনুমতি মেলে না। যাঁরা জীবনে একটিও পাপ করেননি, কেবলমাত্র সেইসব সিদ্ধপুরুষরাই সর্বোচ্চ জ্ঞানলাভ করার জন্য এই আধ্যাত্মিক নগরীতে প্রবেশ করতে পারেন। কারণ জ্ঞানগঞ্জে লুকিয়ে রাখা আছে এই গ্রহের সর্বোচ্চ জ্ঞান। যে জ্ঞান পৃথিবীর ভাগ্য নির্ধারণ করে চলেছে।হিন্দু বা সনাতন ধর্মে জ্ঞানগঞ্জের নাম ‘সিদ্ধাশ্রম’। সিদ্ধপুরুষদের নির্জন আবাস হলো ‘সিদ্ধাশ্রম’। সিদ্ধাশ্রমের কথা বলা হয়েছে চতুর্বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত সহ বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথিতে। বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে সিদ্ধাশ্রম হল শ্রীবিষ্ণুর সর্বশেষ অবতার বা কল্কি অবতারের জন্মভূমি। পুরাণ অনুসারে এই সিদ্ধাশ্রমের অবস্থান, বামন অবতার হয়ে মর্ত্যে আসা শ্রীবিষ্ণুর আশ্রমের পূর্বদিকে।বাল্মিকী রামায়ণে বলা হয়েছে, সিদ্ধাশ্রমের আবাসিক ছিলেন মহামুনি বিশ্বামিত্র। সিদ্ধাশ্রমের পরিবেশকে কলুষিত করা এক দানবকে শাস্তি দেওয়ার জন্য রাম লক্ষ্মণকেও তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন সিদ্ধাশ্রমে। নারদপুরাণে বলা হয়েছে হিমালয়ের গভীরে থাকা সিদ্ধাশ্রম হলো সিদ্ধ পুরুষ দের আশ্রম যেখানে তপস্যারত অবস্থায় আছেন অনেক সিদ্ধ যোগী ও যোগিনী।অনেকে বিশ্বাস করেন মহাবতার বাবাজি এইআশ্রমের আচার্য্য। তার বয়স ২০০০ এর বেশি।জ্ঞানগঞ্জের সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। হিমালয়ের এক গোপনস্থানে, সিদ্ধ-হ্রদ নামে একটি সুবিশাল হ্রদকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছে এই নগররাষ্ট্রটি। জ্ঞানগঞ্জের সুদৃশ্য বাড়ি ও প্রাসাদগুলি বর্ণময় পাথর দিয়ে তৈরি। বাড়ি ও প্রাসাদের দেওয়ালগুলিতে খোদাই করা আছে জ্ঞানগঞ্জের প্রতীক। যে প্রতীকে দেখতে পাওয়া যাবে আট পাপড়ি যুক্ত একটি পবিত্র পদ্মফুলকে। পদ্মটিকে ঘিরে আছে তুষারাচ্ছাদিত পর্বতমালা। পদ্মের মাঝখানে ঝলমল করছে অতীব উজ্জ্বল একটি স্ফটিক।দিনের বিভিন্ন সময় বদলে যায় জ্ঞানগঞ্জের পরিবেশ। গিরগিটি যেমন বিপদের আশঙ্কায় রূপ বদলে প্রকৃতিতে মিশে যায়। ঠিক সেরকমভাবেই হিমালয়ের বুকে প্রকৃতির রঙের মধ্যে হারিয়ে যায় জ্ঞানগঞ্জ। তাই ধরা পড়ে না সাধারণ চোখে। তাই নগররাষ্ট্রটির অবস্থান সম্পর্কেও কারও কোনও ধারণা নেই। বার বার রূপ বদলানোর ফলে জ্ঞানগঞ্জের হদিশ নাকি দিতে পারছে না বিজ্ঞানও। সত্যিই হিমালয়ে এরকম কোনও নগররাষ্ট্রের ধ্বংসাবশেষও খুঁজে পায়নি স্যাটেলাইট। অথচ অসংখ্য হিন্দু ও বৌদ্ধ পুরাণে হিমালয়ে লুকিয়ে থাকা এই নগররাষ্ট্রটির উল্লেখ আছেগৌতম সারাজীবন ধরে যা জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তা জানিয়ে গিয়েছিলেন কয়েকজন শিষ্যকে। এই শিষ্যদের মধ্যে একজন ছিলেন শাম্ভালার রাজা সুচন্দ্র বা দাওয়া সাঙ্গপো।ভগবান বুদ্ধের কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞান লিপিবদ্ধ করে শাম্ভালায় নিয়ে গিয়েছিলেন দাওয়া সাঙ্গপো। লুকিয়ে রেখেছিলেন গোপন স্থানে। তিব্বতীরা বিশ্বাস করেন শাম্ভালা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনও জায়গায় লিপির আকারে সেই জ্ঞান সংরক্ষিত নেই।তিব্বতীয় বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন রহস্যময় শাম্ভালা লুকিয়ে আছে ট্রান্স-হিমালয়ের কোনও দুর্গম জায়গায়। পৃথিবীর যখন ভয়ঙ্কর দুঃসময় আসবে, নীল পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করবেন শাম্ভালার ২৫ তম শাসক। ঔপন্যাসিক জেমস হিলটন শাম্ভালার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে লিখে ফেলেছিলেন ‘Lost Horizon, about the lost kingdom of Shangri-La’ নামের উপন্যাসটি। এখানে হিমালয়ের রহস্যময় নগররাষ্ট্র শাম্ভালা, তাঁর উপন্যাসে হয়ে গিয়েছিল শাংগ্রি-লা, যাতে তিব্বতীদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত না লাগে।১৮৩৩ সালে হাঙ্গেরির গবেষক সিসোমা ডি কোরোস গবেষণা শুরু করেছিলেন জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্ভালাকে নিয়ে। বছরের পর বছর তিব্বতে কাটালেও রহস্য ভেদ করতে পারেননি। এরপর জ্ঞানগঞ্জ রহস্যভেদ করতে ভারতে এসেছিলেন রাশিয়ার বিতর্কিত দার্শনিক ও রহস্যসন্ধানী মাদাম ব্লাভাটস্কি। রহস্যভেদ না করতে পারলেও রহস্যের আগুনে ইন্ধন দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন শাম্ভালা বা জ্ঞানগঞ্জ আসলে লুমেরিয়া ও অ্যাটলান্টিসের মতোই মায়াবী। তাকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। কারণ নগরটি নিজে থেকে ধরা দিতে চায় নাজ্ঞানগঞ্জ বা শাম্ভালার ওপর গবেষণা করেছিলেন রাশিয়ার প্রখ্যাত দার্শনিক, লেখক, প্রত্নতাত্ত্বিক, চিত্রশিল্পী, ধর্মতত্ত্ববিদ নিকোলাই রোয়েরিখ। তাঁর মনে হয়েছিল জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্ভালা লুকিয়ে আছে, মঙ্গোলিয়া ও তিব্বতের মাঝে থাকা আলতাই পর্বতশ্রেণির মধ্যে।ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ওয়েস্টার্ন কমান্ডের অফিসার ছিলেন এল পি ফারেল। ব্রিটিশ হলেও ভারতের দর্শন ও সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর ছিল ভীষণ আগ্রহ। সেই ফারেল সাহেব বলেছিলেন, ১৯৪২ সালে তিনি জ্ঞানগঞ্জে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। তাঁর ডায়রিতে ফারেল সাহেব লিখেছিলেন তার অভিজ্ঞতা।জ্ঞানগঞ্জ বা সিদ্ধাশ্রমের কথা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন প্রখ্যাত দার্শনিক, ভারত-তত্ত্ববিদ ও সংস্কৃত বিশারদ পন্ডিত গোপীনাথ কবিরাজ। জ্ঞানগঞ্জের কথা বলেছিলেন স্বামী বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস। তিনি বলেছিলেন, তাঁকে ছোটবেলায় জ্ঞানগঞ্জে নিয়ে গিয়েছিলেন কোনও সিদ্ধপুরুষ এবং সেখানে বহু বছর সাধনা করেছিলেন তিনি । আজও ভারতে বহু ধর্মগুরু আছেন যারা জ্ঞান গঞ্জ প্রত্যক্ষ ভাবে দেখার কথা বলেন।অদ্ভূত তাদের অভিজ্ঞতা এবং সবার বর্ণনাই প্রায় একই রকম শোনায়।ফিরে আসবো আগামী পর্বে।এমনই কোনো রহস্য নিয়ে।পড়তে থাকুন।ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।