একটি অলৌকিক অভিজ্ঞতা

353

আজ অবধি আপনাদের অনেক অলৌকিক কাহিনী বলেছি, অনেক আধ্যাত্মিক রহস্য নিয়ে আলোচনা করেছি, বহু প্রাচীন মন্দিরের অদ্ভুত সব ইতিহাস আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি।তবে সেগুলি প্রায় সবই প্রচলিত কিংবদন্তী বা জনশ্রুতি যার মধ্যে কিছু শাস্ত্র থেকে পাওয়া পৌরাণিক ঘটনাও আছে। কিন্তু আজ আপনাদের নিজের নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি অদ্ভূত ঘটনার কথা বলবো। ঘটনাটি অলৌকিক কিনা তা আপনারাই ঠিক করবেন।সময়টা আশির দশকের মাঝামাঝি। তখন ছাত্র জীবন। খুব সম্ভবত দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই হাতে অফুরন্ত সময়। কি করবো কোথায় যাবো এই যখন ভাবছি একদিন এক বন্ধু প্রস্তাব দিলো পুরুলিয়া যাওয়ার। তার বাবার একটি যাত্রার দল আছে।পুরুলিয়ায় তার বাবার যাত্রা মঞ্চস্ত হবে।সেই উপলক্ষে সে যাবে। চাইলে সাথে আমিও যেতে পারি। শুনেই যেনো হাতে চাঁদ পেলাম। কারন নাটক থিয়েটার যাত্রার প্রতি আমার একটা টান ছিলো। পুরুলিয়ার ছোউ নাচ নিয়ে অনেক শুনেছি। পত্র পত্রিকায় বিস্তর ছবিও দেখেছি। কখনো সামনাসামনি দেখার অভিজ্ঞতা হয়নি। তাছাড়া ভ্রমন কাহিনীতে মামা ভাগ্নে পাহাড় জয় চন্ডী পাহারের কথাও শুনেছি। ভেবে দেখলাম নিখরচায় এমন বেড়ানোর সুযোগ কোনোমতে হাত ছাড়া করা যাবেনা।কোনো রকমে বাবা মাকে রাজি করিয়ে। ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।প্রথমে ট্রেনে করে পুরুলিয়া তারপর গাড়িতে কয়েক কিলোমিটার পেরিয়ে পৌছালাম। এক প্রত্যন্ত গ্রামে। এখানেই হবে যাত্রা।পৌঁছাতে রাত হয়ে গেছিলো। দূর থেকে ভেসে আসা ধামসা মাদলের শব্দ। ঝিঁঝি পোকার ডাক। বাতাসের সো সো শব্দ। অন্ধকার এক মায়াবী রাজ্যে এনে ফেলেছিলো আমাদের। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিলো এক স্কুল বাড়িতে। রাতে মোটা চালের ভাত। কুমড়োর ঘ্যাট আর সোনা মুগের ডাল দিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে কিছুক্ষন স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে চাঁদের আলোয় ঢাকা কোনো এক নাম না জানা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুক্ষন গল্প করলাম দুই বন্ধু। দলের বাকিরা ততক্ষন ঘুমের দেশে।আমরাও দেরি না করে শুতে গেলাম। ক্লান্তিতে বেশি দেরি হলোনা ঘুম আসতে।পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে নিজেকে এক অদ্ভুত অপার্থিব জগতে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। দূষণ হীন। কোলাহল মুক্ত নির্মল প্রকৃতি। যেদিকে দুচোখ যায় সবুজ আর সবুজ। মেঠো রাস্তা। দূরে উঁচু উঁচু টিলা গুলো যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছে। স্কুল মাঠেই যাত্রার মঞ্চ ও অস্থায়ী দর্শকসন তৈরী হয়েছে। গোটা দল ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে নিজের ঝালিয়ে নেয়ার কাজে। স্থানীয় একটি ছেলের সাথে বেশ আলাপ জমে যায়। শুনলাম কাছেই। বিখ্যাত এক প্রাকৃতিক জলপ্রপাত আছে। নাম বামনি জল প্রপাত।রুটি তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে সেই নতুন বন্ধু ও আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম। সেই জলপ্রপাত দেখতে। বিকেল বিকেল ফিরে এসে বিশ্রাম নিয়ে রাতে যাত্রা দেখবো। এই ছিলো পরিকল্পনা।কিছুটা মেঠো পথ। মাঝে মাঝে সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তর। কথাও আবার লাল মাটির কাঁচা রাস্তা দুদিকে জঙ্গল। এই সব পেরিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম। নতুন আলাপ হওয়া ছেলেটির সাথে কথা বলে জানলাম যে সে এখানকার বাসিন্দা নয়। আসলে সে মামার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। আগে দু একবার মাত্র সে এই পথে এসেছে।তার বাড়ি গিরিডিতে। যাই হোক সূর্য যখন মাথার উপর থেকে কিছুটা ঢলে পড়েছে পশ্চিম দিকে তখন এসে পৌছালাম সেই বিখ্যাত জলপ্রপাতের সামনে।সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে। একটা ছোটো পাহাড় থেকে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্টি জল রাশি প্রবল তেজে আছড়ে পড়ছে নিচে পাথুরে জমিতে। একটা শির্ণ নদী বয়ে চলেছে দূরে কোথাও।এতো জোরে জলের শব্দ হচ্ছে কিছুই আর শোনা যাচ্ছেনা। কিছুক্ষন একটা পাথরের উপর বসে তিন জন সবটুকু প্রাণ ভরে দেখে নিলাম। বিকেল গড়িয়ে আর কিছুক্ষন পর সন্ধ্যে হয়ে যাবে। আলো থাকতে থাকতে ফিরতে হবে। তাই উঠে রওনা দিলাম।কিছুক্ষন হেঁটেই বুঝলাম কি মস্ত ভুল হয়েছে। তিন জনেরই খিদেতে পেট চুই চুই করছে। সাথে খাবার নেয়া উচিৎ ছিলো। ভেবেছিলাম হাতে কিছু টাকা আছে কিছু কিনে খেয়ে নেবো। কিন্তু এই পান্ডব বর্জিত দেশে কোনো দোকান পাঠ চোখেই পড়লোনা।খিদে তেষ্টায় আর ক্লান্তিতে অবস্থা বেশ কাহিল। হাঁটতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে।কোনো রকমে সামনের একটা বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়লো এক গাছে তলায় এক বৃদ্ধা বসে আছেন। পরনে লাল পাড় দেয়া সাদা তবে মলিন শাড়ি। পাশে একটি পুটলি রাখা আছে।আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখে তিনি যেনো মৃদু হাসলেন। আমরাও মন্ত্র মুগ্ধর মতো তার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। জিগেস করলাম আপনি কে? এখানে কি করছেন? মৃদু হেসে বৃদ্ধা বললেন। আমি এখানেই থাকি। তোমাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। আমার কাছে খাবার আছে। তোমরা আগে খেয়ে নাও। আমরা কিছু বলার আগেই তিনি পুটলি খুলে কলা পাতায় আমাদের জন্য মোটা চালের ভাত আর কলাইয়ের ডাল বেড়ে দিলেন।কথা না বাড়িয়ে আমরা খেতে শুরু করলাম। মনে হলো এমন সুস্বাদু খাবার আর এতো তৃপ্তি করে জীবনে আগে কখনো খাইনি। খাওয়া শেষে তিনি বললেন ওই দূরে একটা পুকুর আছে যাও জল খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসো। তার কোনো কথাই যেনো অগ্রাহ্য করা যায়না। এগিয়ে গেলাম তিনজন। সত্যি একটা পুকুর আছে। নির্মল জল। খেলাম। হাত মুখ ধুলাম।তারপর আবার আগের জায়গায় ফিরে এলাম। কিন্তু আশ্চর্য সেই বৃদ্ধা আর নেই। তার কোনো চিহ্নই নেই। মনে হলো যেনো স্বপ্ন দেখলাম একটু আগে। অবাক হয়ে যখন পরস্পরের মুখ চাওয়া চাই করছি তখন বন্ধু বললো। চল আর দেরি করলে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলবো।সে রাতে যাত্রার ভালোই জমে ছিলো। সব শেষে যখন শুতে গেলাম তখন প্রায় ভোর হতে যায়। কিন্তু ঘুম আসেনি। সারারাত সেই বৃদ্ধার হাসি মাখা মুখখানি যেনো চোখের উপর ভাসছিলো। ভোর হয়ে গেলো কখন বুঝতেই পারলাম না। সকালে এলাকার মুরুব্বি গোছের লোক এসে বললো আজ আমাদের ঘুরতে নিয়ে যাবে। কেউ যেতে চাইলো না। রাতে ট্রেন গোছ গাছ আছে। সেই আমরা তিন তার গাড়িতে বেরোলাম ঘুরতে। কাছেই বড়ন্তি বলে একটি পাহাড় ঘেরা সুন্দর গ্রাম আছে। সেখানে যাওয়া হবে। গেলাম সেখানে। সারাদিন ঘুরলাম। অপূর্ব অভিজ্ঞতা।সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে সেখানে।একটি হ্রদ এবং চারপাশে পাহাড় রয়েছে। বিকেলে ফেরার পথে একটি জায়গায় এসে সেটা চিনতে পারলাম। হ্যা কাল এখানেই সেই বৃদ্ধার সাথে দেখা হয়েছিলো। গাড়িটা থামাতে বলে তিন জন নামলাম। এক কাঠুরিয়া কিছু কাঠ কেটে মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে। কথা বলে জানলাম স্থানীয় লোক। তাকে সেই বৃদ্ধার কথা জিগেস করতে তিনি যেনো আকাশ থেকে পরলেন। বললেন এখানে অমন কেউতো থাকেনা। জীবনেও তিনি দেখেননো ওই রকম কোনো বৃদ্ধাকে এখানে।বাকি পথটা গাড়িতে প্রায় চুপ চাপ এলাম। কারুর মুখে কোনো কথা নেই। সবাইকে অন্যমনস্ক।জানিনা তিনি কে ছিলেন। আমার কাছে অন্তত তিনি সাক্ষাৎ মা অন্নপূর্ণা। যিনি কাউকে অভুক্ত থাকতে দেননা।প্রতি বছর অন্নপূর্ণা পুজোর সময়ে আমার বৃদ্ধার কথা মনে পরে। সামনের ২৯ মার্চ আমার গৃহ মন্দিরে অন্নপূর্ণা পুজো অনুষ্ঠিত হবে।জানিনা আর তার দেখা পাবো কিনা। তবে তার আরাধনা করে ধন্য হবো সেই দিন।জানাবেন কিরকম লাগলো আমার এই অভিজ্ঞতা। আমন্ত্রণ রইলো অন্নপূর্ণা পুজোর। ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।