সাধক কথার আজকের পর্বে পরম শ্রদ্ধেয়, পরম পূজনীয়া আনন্দময়ী মা কে নিয়ে বলবো ইংরেজির ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার খেওড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন| আন্দময়ীর প্রকৃত নাম ছিলো নির্মলা সুন্দরী তাঁর মধ্যে ঈশ্বরচেতনার বিকাশ হয় শৈশব থেকেই।তখন থেকেই হরিনামকীর্তন শুনে তিনি আত্মহারা হয়ে যেতেন| ইংরেজির ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে বিক্রমপুরের রমণীমোহন চক্রবর্তীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়। ১৯২৬ সালে যখন সিদ্ধেশ্বরীতে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা হয় ধর্মকর্মে আত্মনিয়োগ করেন আনন্দ নির্মলাদেবী |এই মন্দিরেই একদিন দিব্যভাবে মাতোয়ারা নির্মলা আনন্দময়ী মূর্তিতে প্রকাশিত হন এবং তখন থেকেই তার নাম হয় আনন্দময়ী মা। স্বামীও পরবর্তীকালে সন্ন্যাস গ্রহণ করে ভোলানাথ নামে পরিচিত হন|১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দময়ী স্বামীর সঙ্গে উত্তর ভারতের দেরাদুনে চলে যান এবং সেখানে তার লীলাক্ষেত্র ক্রমশ সম্প্রসারিত হয়|পরবর্তীতে সারা দেশ ভ্রমণ করেন আনন্দময়ী মা, অসংখ্য মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহন করেন|তৈরি হয় একাধিক আশ্রম| আনন্দময়ী মা বলতেন, ”খণ্ড আনন্দে প্রাণ তৃপ্ত হইতেছে না, তাই মানুষ অখণ্ড আনন্দ পাইবার জন্য অখণ্ডের সন্ধান করিতেছে।’ এই আনন্দের জন্যই তাঁর জীবন কেটেছে সাধনায়। কৈশোরে এবং পরবর্তীকালে বিবাহিত জীবনেও তিনি ভাবজগতে বেশিরভাগ সময় ডুবে থাকতেন| শোনা যায় আনন্দময়ী মা-কে তাঁর ভক্তরা কখনও ছিন্নমস্তার মূর্তিতে, কখনও ভুবনেশ্বরী মূর্তিতে আবার কখনও বা সরস্বতী রূপে দেখতেন| তার এক ভক্তের গৃহে একদিন কীর্তনের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। মা আনন্দময়ীর স্বর্গীয় কণ্ঠের কীর্তন শুনতে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তীদেবী ও কন্যা অপর্ণাদেবী। কীর্তনের আসরে আনন্দময়ী মা বসে আছেন। পরনে তাঁর চওড়া লালপাড়ের শাড়ি। কপালে সিঁদুরের বড় ফোঁটা। এক দিব্য-ভাব তাঁর সর্বাঙ্গে, এক স্বর্গীয় সুষমা তাঁর মুখমণ্ডলে। সকলের অলক্ষে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে বাসন্তীদেবী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মা আনন্দময়ীর দিকে। অপলক নয়নে তাকিয়ে আছেন—কিছুতেই দৃষ্টি ফেরাতে পারছেন না। চিত্রার্পিতের মত বসে আছেন তিনি—যেন বাহ্যিক জ্ঞানও তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। একসময় অনেকেরই চোখ পড়ল বাসন্তীদেবীর উপর। সকলেই বাসন্তীদেবীর ওই ভাব বিহ্বল মূর্তি দেখে অবাক। কী এমন হল—কেনই বা তিনি মা আনন্দময়ীর দিকে ওভাবে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছেন? তাঁর ঘনিষ্ঠ একজন মহিলা এগিয়ে গিয়ে বাসন্তীদেবীর সম্বিৎ ফেরালেন—কী এমন হয়েছে প্রশ্ন করায় বাসন্তীদেবী ধীর অথচ শান্ত কণ্ঠে বললেন—অনেক দিন আগেকার কথা—আমার ঠিক মনে নেই। তবে এই মূর্তিকেই যেন আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম। স্বপ্নে দেখেছিলাম, তিনি আমাকে বলছেন—‘তুমি সাবধান হও। তোমার ভয়ানক বিপদ আসছে।’ এই স্বপ্ন দর্শনের কয়েকদিন পরই চিত্তরঞ্জন দাশ দেহত্যাগ করেন। বহু এমন অলৌকিক ঘটনা শোনা যায় মা আনন্দময়ীর জীবনকে কেন্দ্র করে| ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন আনন্দময়ী মায়ের অন্যতম প্রধান শিষ্যা। সুভাষচন্দ্র বসু, কমলা নেহরু, পরমহংস যোগানন্দ ও মাধব পাগলার মতো ব্যাক্তিত্বরা মা আনন্দময়ীর শিষ্যত্ব গ্রহন করেছিলেন| 1982 সালে মহাসমাধিতে লীন হয়ে যান ভারতের এই মহান সাধিকা ও আধ্যাত্মিক গুরু|তাঁর দেহত্যাগের পর শিষ্যা ইন্দিরাগান্ধী শোক জানিয়ে বলেছিলেন ”আমার জীবনে মা আনন্দময়ীর আশীর্বাদ ছিল প্রধান শক্তি ও ভরসা। আজ আমার মর্মবেদনা জানাবার ভাষা নেই।” মহান সাধক ও গুরুরা স্থূল দেহ ত্যাগ করলেও তাদের আধ্যাত্বিক কর্মকান্ড তাদের দেয়া আধ্যাত্বিক শিক্ষা ও জ্ঞান তাঁদের অমরত্ব প্রদান করে|আনন্দময়ী মাও তাঁর অসংখ্য ভক্ত শিষ্য দের মনে সদা বিরাজমান| মহান এই গুরু ও সাধিকা কে প্রনাম জানিয়ে শেষ করছি আজকের পর্ব|আগামী পর্বে আবার দেখা হবে|পড়তে থাকুন|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|