রথযাত্রার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন

1126

আজ পবিত্র রথযাত্রা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে যে সকল ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক উৎসবগুলি সর্বাধিক জনপ্রিয় ও পবিত্র তার মধ্যে একদম প্রথম সারিতে রয়েছে রথ এই রথ যাত্রা যা আজ আর শুধু উড়িষ্যা বা বাংলা নয় গোটা বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব গুলির অন্যতম|

শাস্ত্র মতে তখন দ্বাপর যুগ, শেষ হয়েছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ|এক ব্যাধের বানের আঘাতে প্রান হারান শ্রী কৃষ্ণ তার সৎকার করেন অর্জুন কিন্তু অক্ষত থাকে কৃষ্ণের নাভী এই নাভী উদ্ধার করেন এক সবর রাজ তিনি নীল মাধব রূপে তা পূজা করতে লাগলেন|এর পর কেটে গেলো বহু যুগ পুরীর রাজা এক বিশাল দেবালয় গড়ে তুললেন এবং ইচ্ছা প্রকাশ করলেন নীল মাধব কে প্রতিষ্ঠিত করবেন তার মন্দিরে এবং নীল মাধবের সন্ধানে রাজা লোক পাঠালেন চারিদিকে, নেতৃত্বে রাজার বিশ্বস্ত লোক বিদ্যাপতি|এক জঙ্গলে পথ হারিয়ে বিদ্যাপতি আশ্রয় নিলেন এক সবর রাজের গৃহে, বিবাহ করলেন তার কন্যা কে এবং একদিন আবিষ্কার করলেন যে বংশ পরম্পরায় এই সবর রাজের কাছেই আছে নীল মাধব, অনুরোধ করে তা তিনি দর্শন করলেন|এবং ঘটনা চক্রে এই খবর রাজার কানে পৌছালো|সবর রাজ তার ইষ্ট দেব কে ছাড়তে না চাইলেও স্বয়ং নীল মাধবের ইচ্ছায় তা রাজার হাতে তুলে দিতে সম্মত হলেন কিন্তু|কিন্তু হটাৎ অদৃশ্য হয় নীল মাধব এবং দৈব বাণী হয় যে সমুদ্রে ভেসে আসবে কাঠ তা দিয়ে বানাতে হবে বিগ্রহ|তাই হলো কিন্তু যতক্ষণ না বিদ্যাপতি ও সবর রাজ হাত মিলিয়ে চেষ্টা করলেন নাড়ানো গেলোনা সেই কাঠ|বৃদ্ধের বেশে রাজ সভায় একদিন হাজির হয়ে মূর্তি তৈরির ভার নিলেন স্বয়ং বিশ্ব কর্মা|শর্ত রইলো একুশ দিনের আগে কেউ মূর্তি দর্শন করবেন না|কাজ শুরু হওয়ার চোদ্দো দিনের দিন রানী গুন্ডিচার কৌতূহলে খুলে গেলো শিল্পীর রুদ্ধ দ্বার|দেখা গেলো অদৃশ্য হয়েছেন শিল্পী এবং রয়েছে অসমাপ্ত তিনটি মূর্তি|রাজা মর্মাহত হলেন কিন্তু দৈব বাণী এলো যে জগন্নাথ অর্থাৎ জগতের নাথ স্বয়ং ভগবান ওই বিশেষ রূপেই পূজিত হতে চান|ওই বিগ্রহই প্রতিষ্ঠিত হলো মন্দিরের|

মনে করা হয় দীর্ঘ বিরতির পর শ্রী কৃষ্ণর বৃন্দাবন যাত্রাকেই উদযাপন করা হয় রথ যাত্রা পালনের মাধ্যমে|প্রথম ও প্রধান রথ যাত্রা নিঃসন্দেহে পালিত হয় জগন্নাথ ধাম পুরীতে|প্রথমে রাজ পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় ও পরবর্তীতে সরকার জনসাধারণএর উদ্যোগে প্রতি বছর পুরীতে ওই বিশেষ তিথী তে বিরাট আকারে পালিত হয় রথ যাত্রা|এই পরম্পরা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে|
বোন সুভদ্রা ও দাদা বলরাম বা বলভদ্রকে নিয়ে রথে চড়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুন্ডিচারবাড়ি যান। সেখান থেকে সাতদিন পরে আবার নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। এই যাওয়াটাকেই জগন্নাথের মাসির বাড়ি যাওয়া বলে। রথের দিন তিনটি রথ পর পর যাত্রা করে মাসির বাড়ি। প্রথমে যায় বলরামের রথ, তারপর সুভদ্রা এবং সবশেষে জগন্নাথের রথ। রথে চড়ে এই গমন ও প্রত্যাগমনকে সোজা রথ এবং উল্টোরথ বলে|তিনটি রথ থাকে যাদের প্রত্যেকের নিজস্ব বৈশিষ্ট আছে|জগন্নাথের রথের নাম নন্দী ঘোষ, বলরামের রথের নাম তালধ্বজ ও সুভদ্রার রথের নাম দর্পদলন|এই রথ নির্মানে কোনো আধুনিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি ব্যবহার হয়না এবং বংশ পরম্পরার কারিগররা সকল নিয়ম নিষ্ঠা ও প্রথা মেনে রথ প্রস্তুত করেন|আজও পুরীর বর্তমান রাজা সোনার ঝাড়ু ব্যবহার করে রথের যাত্রার আগে তার পথ পরিষ্কার করে থাকেন|প্রচলিত বিশ্বাস রথে পুরীতে বৃষ্টিপাত হবেই|

পরবর্তীতে পুরীর বাইরে বাংলায় রথযাত্রা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং মনে করা হয় এই সংস্কৃতির সম্ভবত সূচনা হয়েছিল শ্রীচৈতন্যদেবের নীলাচল অর্থাৎ পুরী যাওয়ার পর থেকে| চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর অনুকরণে রথযাত্রার শুরু করেন এবং দেখতে দেখতে বহু রাজপরিবার ও এই মহা সমারোহে এই উৎসব পালন করতে শুরু করে|আরো কিছু কাল পরে ইসকন ও শ্রীল প্রভুপাদের হাত ধরে রথ যাত্রা দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে পা রাখে ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে সারা বিশ্ব জুড়ে|

আজ বাংলার নানা স্থানে বিরাট আকারে রথ যাত্রা উৎসব পালন হয় যার মধ্যে মাহেশের রথ যাত্রা বিশেষ উল্লেখযোগ্য|যাত্রা শব্দের প্রকৃত অর্থ গমন তাই জগন্নাথের রথযাত্রা এবং উল্টোরথ হিন্দু-বাঙালিদের কোনও কাজ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সূচনার পবিত্র দিন হিসেবে গণ্য করা হয়| বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব দূর্গাপূজোর সূচনাও হয় এই রথ কিংবা উল্টোরথের দিন|করোনা থাকার ফলে এবছর পুরী সহ সর্বত্র রথ যাত্রা অনুষ্ঠিত হবে কিছু বিধি নিষেধ বজায় রেখে তবে ধর্মীয় আবেগ ও নিষ্ঠার কোনো অভাব নেই প্রভুর অগনিত ভক্ত ও অনুরাগীদের মধ্যে|আপনাদের সবাইকে রথ যাত্রার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|