একান্ন পীঠ – জ্বালা মুখী

63
আজকের শক্তিপীঠ পর্ব জ্বালামুখী নিয়ে।ভারতের হিমাচল প্রদেশের কাংড়া উপত্যকায় অবস্থিত জ্বালা মুখী শক্তি পীঠ।
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যেও এই পীঠের উল্লেখ আছে, সেখানে বলা হচ্ছে-
“জ্বালমুখে জিহ্বা তাহে অগ্নি অনুভব
দেবী অম্বিকা নাম উন্মত্ত ভৈরব”
পুরান মতে এখানেই কালীধর পাহাড়ে কোথাও দেবী সতীর জিহ্বা পতিত হয়েছিল।
এই শক্তি পীঠে দেবতাদের তেজ সম্পন্ন হয়ে একটি অগ্নিশিখা সর্বদা নাকি জ্বলছে সেই থেকেই নাম জ্বালা মুখী।রাজা ভূমিচন্দ্র সেই স্থানের অনেক সন্ধান করেন কিন্তু খুঁজে না পেয়ে নগরকোটের সামনে একটি দেবীর মন্দির নির্মাণ করেন পরে একদিন রাজা এক গোয়ালার কাছে দেবীর অগ্নি শিখার কথা শুনলেন এবং সেই স্থান খুঁজে পেয়ে সেখানেই দেবীর মন্দির নির্মাণ করলেন ।মহাভারত কালে নাকি পঞ্চপাণ্ডব এই স্থানে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন এমনটাও শোনা যায়|
বহু কিংবদন্তী ও অলৌকিক মহিমা প্রচারিত আছে এই শক্তি পীঠ ঘিরে|এই পীঠের দেবী হলেন- সিদ্ধিদা আর ভৈরব হলেন উন্মত্ত । আবার কারোর মতে এই পীঠের দেবী হলেন অম্বিকা, ভৈরব হলেন উন্মত্ত |মন্দিরের কাছেই এক পাহাড়ে ভৈরব বিরাজমান |
মায়ের মন্দিরে কোনো বিগ্রহ নেই|এক জ্বলন্ত দিব্য অগ্নি শিখাকে দেবী রূপে পূজা করা হয়|মায়ের মন্দিরের উত্তর দিকের দেওয়ালের মাঝে মায়ের মূল জ্যোতি বা আগুনের শিখা বিরাজমানা|বলা হয় এই আগুনের শিখাই হলেন মা জগদম্বা সিদ্ধিদা বা অম্বিকা যা জ্বালামুখী নামেই বেশি বিখ্যাত ভক্তেরা যে যে নামে ডাকবে মা তাদের কে সেই রূপেই কৃপা করবেন । এই আগুনের শিখা অনবরত জ্বলছে| কোনদিন নেভেনি |
বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই শক্তি পীঠ| মুঘল সম্রাট আকবর, দেবীর মহিমা প্রত্যক্ষ করতে একবার এই পীঠে আসেন। আবুল ফজলের রচিত ‘আইন- ই – আকবরি’ তেও এই পীঠের কথা উল্লেখ আছে।দেবীর অলৌকিক ক্ষমতার প্রমান পেয়ে আকবর দেবীর মহিমা স্বীকার করেন এবং দেবীর মন্দিরে একটি সোনার ছাতা প্রদান করেন|
একবার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরোজ শাহ জ্বালা দেবীর মন্দির লুঠপাঠ ও ধ্বংস করার জন্য রওনা হয়েছিলেন কিন্তু পথে এক জায়গা তে তারা মৌমাছিল আক্রমণের শিকার হলেন| কাতারে কাতারে ফিরোজের সেনারা মৌমাছির বিষাক্ত হূলে মারা পড়তে লাগলো|অবশেষে ফিরোজ শাহ পরাজয় স্বীকার করে পিছু; হটলেন|মনে করা হয় দেবীর ইচ্ছাতেই মৌমাছির আক্রমণের স্বীকার হয়েছিলেন ফিরোজ শাহ|কিছু ঐতিহাসিকের মতে ঔরংজেবও এই মন্দির ধ্বংস করতে চেয়ে ব্যর্থ হন|শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিং এই মন্দিরে তাঁদের ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থসাহিব’ নিত্য পাঠ ও দেবীর পূজা করতেন । তিনি ১৮১৫ খ্রীঃ মন্দির সংস্কার করে এক ভব্য মন্দির নির্মাণ করেন|পরবর্তীতে মহারাজা রঞ্জিত সিং দেবীর মন্দিরের চূড়া শোনা দিয়ে বাধিয়ে দেন।
বর্তমানে প্রায় সারা বছরই এই মন্দিরে দর্শনার্থীদের ভীড় থাকে| মন্দিরের তোরণদ্বার টি বিশাল। দুপাশে দুটি বাঘের মূর্তি এত সুন্দর মনে হয় যেনো জীবন্ত। বাঘ হল ভগবতীর বাহন । তাই মায়ের মন্দিরে মায়ের বাহন কেও পূজা করা হয় । এর পর সূর্য কুন্ডের পাশ দিয়ে মন্দিরের দিকে যেতে হয় । সূর্য কুন্ড এক অপূর্ব দিব্য অলৌকিক কুন্ড। মানুষের বিশ্বাস এখানে স্নান করলে সর্ব পাপ নাশ হয় । মন্দির প্রাঙ্গনে রয়েছে রুদ্রকুন্ড, গোমুখী, ব্রহ্মকুন্ড নামক তিনটি কুণ্ড| রুদ্রকূন্ডর জল অনবরত ফোটে তবে তাপমাত্রা কম।
এই পবিত্র জল স্পর্শের জন্য দীর্ঘ লাইন দেখা যায়| প্রথা অনুসারে এই পীঠ দর্শন করে এখানে একটি অতি প্রাচীন ভগবান রামচন্দ্রের মন্দির দর্শন করতে হয় এবং শেষে উন্মত্ত ভৈরবের পুজো করতে হয়।
আজ এখানেই শেষ করছি।ফিরে আসবো পরবর্তী একান্ন পীঠ পর্ব নিয়ে। পড়তে থাকুন।
ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।