ভক্তের ভগবান – সাক্ষী গোপালের কথা

28

ভক্তের ভগবান – সাক্ষী গোপালের কথা

পন্ডিতজি ভৃগুশ্রী জাতক

ভক্তের সাথে ভগবানের লীলা নতুন কিছু নয়। তবে একবার ভগবান শ্রী কৃষ্ণ তার এক গরীব ব্রাহ্মণ ভক্তের সাথে এমন এক লীলা করে ছিলেন যা আজও প্রবাদ রূপে মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে আছে।

ভারতের ওড়িশার কটক শহরে রয়েছে সাক্ষী গোপালের একটি মন্দির।শোনা যায় এই মন্দিরের বিগ্রহটি আগে ছিল বৃন্দবনের এক মন্দিরে। সেখান থেকে স্বয়ং ওড়িশার এই স্থানে এসেছিল ওই মূর্তি। আর এই মূর্তির নিজে পায়ে আসার ঘটনাই ভগবানের লীলা ।

একবার দক্ষিণ ভারতের এক ব্রাহ্মণ কৃষ্ণ ভক্ত। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব নিজের ছেলের হাতে তুলে দিয়ে তীর্থদর্শনে বেরিয়ে পড়েন। মথুরায় তার সঙ্গে একজন যুবক ব্রাহ্মণের আলাপ হয় একসঙ্গে মিলেই তারা ঘুরে দেখতে থাকেন মথুরা এবং বৃন্দাবনের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। হঠাৎ করেই ব্রাহ্মণের মনে হয় এমন ছেলে তাঁর কন্যার জন্য একেবারে উপযুক্ত পাত্র। তৎক্ষণাৎ নিজের মনের কথা সেই যুবককে বলেন ব্রাহ্মণ। কিন্তু ব্রাহ্মণত্বের বিচারে সেই যুবক কুলীন ছিল না, তাই প্রাথমিক ভাবে এমন প্রস্তাবে অসম্মতি জানায় ওই যুবক। তার যুক্তি ছিল, এই বিয়ে ব্রাহ্মণ সমাজ কিছুতেই মেনে নেবে না। তখন ওই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ যুবককে আশ্বস্ত করেন যে এমন কোনও পরিস্থিতি তিনি তৈরি হতে দেবেন না। তখন তাঁরা দুজনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বৃন্দাবনের এক গোপাল মন্দিরে। ব্রাহ্মণ সেই মন্দিরের দেবতাকে সাক্ষী করে শপথ করেন যে তিনি তাঁর কন্যার বিবাহ ওই যুবকের সঙ্গেই দেবেন।

দুজনে তীর্থযাত্রা শেষে দুজনে ঘরে ফিরে যায়।
কিন্তু সমস্যা শুরু হয় সেই পাত্রের পরিচয় সকলে জানার পর। ব্রাহ্মণের নিজের পরিবার সহ সমাজের প্রত্যেকেই এই বিয়ের বিরুদ্ধে একেবারে বেঁকে বসেন। ফলত বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ পড়েন এক ভয়ানক ধর্মসঙ্কটে। একদিকে তাঁর প্রতিজ্ঞাভঙ্গের ভয়, অন্যদিকে সমাজচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা। এমন সময় হঠাৎই সেখানে হাজির হন সেই যুবক। কিন্তু তাঁকে চরম অপমান করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেন গ্রামবাসী ও ওই বৃদ্ধের আত্মীয়রা। অপমানিত যুবক গ্রামবাসীদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন, যে মন্দিরে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই মন্দিরের বিগ্রহকেই তিনি সাক্ষী হিসেবে সকলের সামনে নিয়ে আসবেন।তিনি নিজে দেবেন সাক্ষী|মনের দুঃখে যুবক হাজির হন বৃন্দাবনের সেই গোপালের মন্দিরে। দেবতাকে জানান তাঁর সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের কথা। সেই ডাকে সাড়াও দেন স্বয়ং গোপাল। তিনি রাজি হন সাক্ষী দিতে এবং যুবকের কথামতোই পাথরের বিগ্রহ রূপে স্বশরীরে তিনি সাক্ষী দিতে রওনা হন দক্ষিণ ভারতের ওই গ্রামের উদ্দেশে।গোপালের একটি শর্ত ছিলো|যাওয়ার পথে যুবক যেন পিছন ফিরে মূর্তির দিকে না দেখে। পিছনে তাকালেই তিনি থেমে যাবেন ।যুবক শর্ত মেনেই নিতেই শুরু হয় যাত্রা। বেশ খানিকটা পথ যাওয়ার পর ওড়িশার কাছাকাছি একটি গ্রামে এসে যুবকের মনে হয় গোপালের বিগ্রহ আর সঙ্গে আসছেন না। সন্দেহের বশেই একটিবারের জন্য পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখেন|ব্যাস শর্ত অনুসারে গোপাল সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়েন।

ভগবানের উপর যতক্ষণ ভক্তের বিশ্বাস ছিলো ভগবান তার সাথে ছিলো|বিশ্বাস ভঙ্গ হতেই তিনি আবার পাথরের মূর্তিতে পরিণত হলেন এবং তার গতি স্তব্ধ হলো|সর্বত্র রটে যায় ভগবানের এই লীলার কথা দলে দলে মানুষ ওড়িশার ওই গ্রামে জমায়েত হতে থাকেন। খবর পৌঁছায় সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বাড়িতেও। তিনিও সদলবলে সেই গ্রামে উপস্থিত হন।সবাই নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং ব্রাহ্মণকন্যার সঙ্গে সেই যুবকের বিয়ের আয়োজন করেন|

যে স্থানে গোপালের গতি স্তব্ধ হয়ে ছিলো সেই স্থানে একটি মন্দির বানিয়ে দেওয়া হয়। মন্দিরে স্থাপিত সেই গোপালের বিগ্রহ পরিচিত হয় ‘সাক্ষী গোপাল’ নামে|

ফিরে আসবো ভগবানের আরো এক লীলা নিয়ে। থাকবে আরো এক ভক্তের কথা। পড়তে থাকুন।
ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।