Home Blog Page 124

পৌরাণিক অসুর কথা – বৃত্রাসুর

এই ব্যতিক্রমী ধারাবাহিক লেখনী আপনাদের ভালো লাগছে জেনে উৎসাহিত বোধ করছি তাই ধারাবাহিকতা বজায় রেক্যে পৌরানিক অসুর কথার দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে আজ আপনাদের সামনে উপস্থিত|এই পর্ব গুলিতে পুরানে উল্লেখিত অসুর চরিত্র গুলিকে সামনে রেখে বা কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে তাদের ব্যবহার করে সহজ সরল ভাবে একাধিক দেবাসুর সংগ্রামের কাহিনী আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি|এই প্রচেষ্টায় আমি কতোটা সফল তা আপনারা বলবেন তবে আমি চেষ্টা করবো আগামী মহালয়া অবধি এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে|আজ দ্বিতীয় পর্বে লিখবো অসুর বৃত্রাসুর কে নিয়ে|

আপনারা অনেকেই হয়তো পড়েছেন বা জানেন দধীচি মুনির কথা তার আত্মত্যাগের কথা এবং দেবরাজ ইন্দ্র কতৃক বৃত্রাসুর বধ হওয়ায় দধীচি মুনির কি অবদান ছিলো|কিন্তু আজ বিস্তারিত জানবো কে এই বৃত্রাসুর, কি তার জন্ম বৃত্তান্ত তারপর আসবো দধীচি মুনির আত্মত্যাগ এবং বৃত্রাসুর বধ হওয়ার ঘটনায়|

দেব শিল্পী বিশ্বকর্মা একবার ইন্দ্রের প্রতি কোনো কারনে বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ হয়ে এক প্রবল পরাক্রমী যোদ্ধা সৃষ্টি করলেন যার নাম বিশ্বরূপ|এই বিশ্বরূপ চূড়ান্ত ক্ষমতা অর্জনের লক্ষে শুরু করলেন কঠোর তপস্যা|তার আসল উদেশ্য ও তপস্যায় ভীত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র নানা ভাবে তার তপস্যা ভঙ্গ করতে চাইলেন কিন্তু ব্যর্থ হলেন শেষে ছলের আশ্রয় নিয়ে ইন্দ্র তাকে বধ করলেন|এই ঘটনায় প্রচন্ড রেগে গেলেন বিশ্বকর্মা এবং এক অধিক শক্তিশালী পুত্র লাভের আশায় এক বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করলেন|অবশেষে সেই যজ্ঞের হোমঅগ্নি থেকে সৃষ্টি হলো বৃত্রাসুরের|

বৃত্রাসুরের জন্ম রহস্য নিয়ে আরেকটি পৌরাণিক মতবাদ প্রচলিত আছে যেখানে বলা হচ্ছে বৃত্রাসুর প্রজাপতি ত্বষ্টার পুত্র এক অসুর। ইন্দ্র ত্রিশিরাকে বধ করলে ত্বষ্টা ত্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্রকে বিনষ্ট করার জন্য অগ্নিতে আহুতি দিয়ে বৃত্রাসুরকে উৎপন্ন করেন|

কোন পৌরানিক ঘটনা ঠিক এবং কোন ঘটনা ভুল সেই বিতর্কে জড়ালে আসল ঘটনা চাপা পড়ে যাবে তাই ওই আলোচনা তোলা থাক ভবিষ্যতের জন্য|

বৃত্রাসুর ইন্দ্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঘোষণা করেন,বৃত্রাসুর গিয়ে ইন্দ্রকে আতর্কিতে গ্রাস করেন। বৃত্রাসুর মুখ হাঁ করলে ইন্দ্র অবশ্য দেহ সংকুচিত করে বেরিয়ে আসতে পারলেন, কিন্তু বহুকাল যুদ্ধ করেও ইন্দ্র বিত্রাসুরকে পারাজিত করতে পারলেন না এবং বৃত্রাসুর ইন্দ্রকে পরাজিত ও স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করলেন কিন্তু এতেও তার ক্রোধ ঠান্ডা হলো না|ইন্দ্রকে বধের উদ্দেশ্যে বৃত্রাসুর কঠোর তপস্যা শুরু করলেন|

ইন্দ্রের প্রান সংশয় দেখা দিলে ঋষিরা বৃত্রকে ইন্দ্রের সঙ্গে সন্ধি করার প্রস্তাব দিলেন বৃত্র সব শুনে বললেন যে, তিনি তাতে রাজি আছেন। কিন্তু ঋষিদের কথা দিতে হবে যে, শুষ্ক বা আদ্র্র বস্তু দ্বারা, প্রস্তর কাষ্ঠ বা অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা, দিবসে বা রাত্রিতে ইন্দ্র অথবা অন্যদেবতারা ওঁকে বধ করতে পারবেন না। ঋষিরা তাতে রাজি হলে সন্ধি স্থাপিত হল।অর্থাৎ দেবতা দের সব অস্ত্র সস্ত্র বৃত্যাসুর কে বধ করার ক্ষমতা হারালো|

এদিকে ক্রমে বৃত্যাসুর যখন অত্যাচারি হয়ে উঠতে লাগলো এবং এক সময় তাকে বধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় রইলো না, কিন্তু অস্ত্র নেই | তখন ঋষিরা ঠিক করলেন কোনো ত্যাগী এবং তেজময় সন্যাসীর অস্থি থেকে অস্ত্র তৈরী করে বৃত্যাসুর কে বধ করতে হবে|

ত্যাগের জন্য নির্বাচিত সেই মহান বৈদিক ঋষি হলেন দধীচি|বলা হয় শিবের বরে দধীচি মুনি বজ্র কঠিন অস্থি পেয়ে ছিলেন|এখানে দধীচি মুনির পরিচয়টাও সংক্ষেপে দিয়ে রাখা প্রয়োজন, ভগবত্‍ পুরাণ অনুযায়ী তিনি অথর্বন ঋষি ও চিতির পুত্র |বিশ্বস করা হয় এই অথর্বন ঋষিই রচনা করেছিলেন অথর্ব বেদ |পাণিনী তাঁর অষ্টাধ্যয়ীতে ব্যাখ্যা করেছেন তার নামের অর্থ |দুধ বা দধি থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে তিনি শক্তিশালী হয়েছিলেন তাই তার না দধীচি|

পরিকল্পনা অনুযায়ী দেবতারা দধীচীর কাছে তার অস্থি চাইলেন|এই অনুরোধ শুনে দধীচি নামক এই মহুমুনি সাধক আত্মত্যাগ করতে রাজি হন। দধীচিকে হত্যা করা হয় এবং তার দেহের হাড় দিয়ে বৃত্তাসুরকে হত্যার জন্য ইন্দ্রের জন্য একটি বিশেষ বজ্র তৈরি করা|ইন্দ্রের প্ৰিয় অস্ত্র ত্রিশিরা কে বধ করার সময় ধ্বংস হয়েছিলো|তার পর ইন্দ্র ও বৃত্তাসুরের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হলো|অবশেষে সেই বজ্র দিয়ে ইন্দ্র একটি বিশেষ সময়ে বৃত্রাসুর কে যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং হত্যা করেন |একদিকে ঋষি দের বর অটুট থাকলো অন্যদিকে অশুভ শক্তির বিনাশ হলো বৃত্রাসুরের হাত থেকে রক্ষা পেলেন ইন্দ্র|রক্ষা পেলো স্বর্গ তথা গোটা সৃষ্টি|ইন্দ্র কে অবশ্য বৃত্রাসুর বধের পর বিশেষ যজ্ঞের মাধ্যমে ব্রহ্মহত্যার পাপ খণ্ডন করতে হয়েছিলো|

আমাদের শাস্ত্রে দধীচি মুনির এই আত্মত্যাগ স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে, দেবতারা যেমন শুভ শক্তির এবং অসুররা যেমন অশুভ শক্তির প্রতীক ঠিক তেমনই দধীচি মুনি হলেন আত্মত্যাগের প্রতীক যিনি হাসি মুখে নিজের প্রান বিসর্জন দিয়ে ছিলেন জগতের কল্যানে|

বৃত্রাসুরের কথা আপাতত এখানেই শেষ করছি|ফিরে আসবো পরের পর্বে অন্য কোনো অসুরের কথা নিয়ে|চোখ রাখুন আমার ইউটিউব ও ফেসবুকের লাইভ অনুষ্ঠানে আর অনলাইন জ্যোতিষ পরামর্শ বা প্রতিকারের জন্য ফোন করুন আমাকে|কথা হবে|ভালো থাকুন|

পৌরানিক অসুর কথা – মহিষাসুর

পন্ডিতজি ভৃগুর শ্রী জাতক

অমাবস্যা ও মহালয়া আসন্ন তাই এই তিথি কে কেন্দ্র করে অসংখ্য মানুষ শাস্ত্র মতে তাদের গ্রহ গত দোষ খণ্ডনের জন্য যোগাযোগ করছেন সেই কারনে পেশা গত ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে|তবে ধারাবাহিক লেখনীর যে দায়িত্ব হাতে নিয়েছি তাকেও সমান গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে বিবেচনা করে আজ পৌরানিক অসুর কথার একটি বিশেষ পর্ব নিয়ে আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত|আজকের পর্বে মহিষাসুর|

অসংখ্য দেব দেবীর পাশাপাশি আমাদের পুরানে অসুরের সংখ্যাও কিছু কম নয়|এদের কয়েকজনের কথা আমি আপনাদের ইতিমধ্যে বলেছি|তবে সব থেকে আলোচিত এবং জনপ্রিয় অসুর চরিত্র বোধহয় মহিষাসুর|দেবী দুর্গার সাথে পূজিত হওয়ার দরুন মহিষাসুর বাংলা তথা গোটা বিশ্বের দরবারে এক অতি পরিচিত মুখ|তার বোধ হওয়ার কাহিনী হয়তো আমরা সবাই জানি কিন্তু তার জন্ম বৃত্তান্ত সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অনেকেরই অজানা|আজ চেষ্টা করবো মহিষাসুর সম্পর্কে কিছু স্বল্প প্রচারিত বিষয়ে আলোকপাত করার|

মহিষাসুরের পিতাও ছিলেন এক অসুর তার নাম রম্ভ|অগ্নিদেবকে মতান্তরে মহাদেবকে তপস্যায় প্রসন্ন করে রম্ভ বর লাভ করেছিলো যে সে এক ত্রিকাল জয়ী বলশালী পুত্রের পিতা হবে|এই পুত্রকে কোনো পুরুষ বোধ করতে পারবেনা|পরবর্তীতে এক মহিষী কে ভালো বেশে তার সাথে মিলিত হয় রম্ভ|কিছুকাল পরে এক মায়াবী মহিষের সাথে সংঘর্ষে মৃত্য হয় রম্ভের|যক্ষেরা মিলে রম্ভর চিতায় অগ্নি সংযোগের ব্যবস্থা করে|রম্ভের অর্ধাঙ্গিনী সেই মহিষীও রম্ভার সাথে মৃত্যু বরণ করতে চেয়ে সেই চিতায় উঠে বসে|কিন্তু দেবতাদের বর মিথ্যে হতে পারেনা তাই সেই জ্বলন্ত চিতায় মাতৃ গৰ্ভ থেকে বেড়িয়ে আসে এক অসুর শিশু|এই শিশুই পরবর্তীতে হয় মহিষাসুর|

পরবর্তীতে অত্যাচারী হয়ে ওঠে মহিষাসুর ও স্বর্গ মর্ত পাতাল অধিকার করে নেয়|তাকে বোধ করতে আবির্ভুত হন দশ ভুজা দেবী দূর্গা|মহিষাসুর কে বধ করে দেবী হন মহিষাসুর মর্দিনী|
ত্রিকাল জয়ী বীর যোদ্ধা মহিষাসুরকে বধ করা সহজ ছিলোনা|মহিষাসুর একাধিক বার একাধিক রূপে দেবীর সাথে যুদ্ধ করেছিলেন|দেবীর দুর্গাও একাধিক রূপে একাধিক বার তার বিনাশ করেছেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে|মহিষাসুর জন্মগ্রহণ করেন তিনবার। ত্রিবিধ রূপ ধারণ করে তাঁকে তিনবারই বিনাশ করেন এই দেবী। মহিষাসুরকে বধ করার জন্য প্রথমে অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডা রূপে, দ্বিতীয়বার ভদ্রকালী এবং তৃতীয়বার বধ করলেন দশভুজা দেবী দুর্গা রূপে|দেবীর এই দশ ভুজা মহিষাসুর মর্দিনী রুপই পূজিত হয় বাংলার ঘরে ঘরে|

দেবী মূর্তির সাথে সর্বত্র মহিষাসুর কেনো পূজিত হন শাস্ত্রে এরও নিদ্দিষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে|মৃত্যুর পূর্বে মহিষাসুর স্বপ্নে দেবীর দর্শন করেন এবং দেবীকে অনুরোধ করে বলেন যে আপনার হাতে মৃত্যুর জন্য কোনও দুঃখ বা ক্ষোভ নেই এতটুকুও। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমিও যাতে সকলের পূজিত হই তারই ব্যবস্থা করুন দেবী। এছাড়া আর কিছুই চাই না আমি।’দেবী তখন মহিষাসুরকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘উগ্রচণ্ডা, ভদ্রকালী আর দুর্গা, এই তিন মূর্তিতে আমার পদলগ্ন হয়ে তুমি সব সময়েই পূজ্য হবে দেবতা, মানুষ ও রাক্ষসদের।’ সেই থেকেই এই রীতি প্রচলিত|

আমাদের দেশের কিছু আদিবাসী ও বিশেষ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আশ্চর্য জনক ভাবে মহিষাসুরকে প্রধান আরাধ্য দেবতা হিসেবে পূজা করার রীতিও আছে|এমনকি উত্তর বঙ্গের একটি বিশেষ জন সমাজ নিজেদের আজও মহিষাসুরের বংশধর বলে দাবী করে ও যথেষ্ট গর্ব অনুভব করে|

আজ মহিষাসুর কে নিয়ে এই পর্ব এখানেই শেষ করছি|মহালয়া উপলক্ষে আপনাদের হৃদয়েশ্বরী সর্বমঙ্গলা মায়ের মন্দিরে বিশেষ পূজা, হোম যজ্ঞ ও গ্রহ দোষ খণ্ডনের ব্যবস্থা করা হয়েছে|প্রযুক্তির ব্যবহারে এই আধ্যাত্মিক কর্মকান্ড পৌঁছে দেয়া হবে আপনাদের কাছে|যোগাযোগ করুন, যুক্ত হন এবং সাক্ষী থাকুন এক অভূতপূর্ব আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার|ভালো থাকুন|ধন্যবাদ|