বর্তমানে রয়েছি কোচবিহারে, যদিও আগেও এসেছি উত্তর বঙ্গের এই ঐতিহাসিক এবং স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে, তবে এবারেরআসা টা একটু আলাদা|শীতের আমেজ গায়ে মেখে, অদ্ভুত সব ঐতিহাসিক নিদর্শন ও ধর্মীয় স্থান গুলি ঘুরে দেখতে বেশ লাগছে… আরো ভালো লাগবে এই অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে পারলে, তাই অবসরে একটু লেখা লেখিতে মন দিলাম…..প্রথমে কোচ বিহারের ইতিহাসটা সংক্ষেপে বলে নিই তাহলে বাকিটা পড়তে আপনাদের আরো ভালো লাগবে -এককালে কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল এই কোচবিহার জেলা। বলা হয়, এই স্থানে কোচ বংশ প্রায় ৫০০ বছর শাসনকার্য চালায়। ১৫৩০ সালে কোচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ এই কোচবিহারে এসে শাসন শুরু করেন। তারপর তাঁর ছেলে নরনারায়ণ এই রাজ্যকে বহুদূর বিস্তৃতি দেন।কোচ রাজাদের নাম অনুসারেই এই স্থানের নাম হয় কোচ বিহার, ১৭৭২ সালে ভুটানের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে কোচবিহার রাজ ধৈর্জেন্দ্র নারায়ণ ও ওয়ারেন হেস্টিংস-এর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়|যার ফলে কোচ বিহার ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে যায়|পরবর্তীতে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, অল্প কিছু ভৌগোলিক রাজনৈতিক জটিলতা অতিক্রম করে কোচ বিহার ভারত তথা বাংলার অন্তরভুক্ত হয়|কোচ বিহার বরাবরই ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রচিন নগরী, সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রচিত ‘শাহজাহাননামা’ গ্রন্থে কোচবিহার নামটি উল্লেখ রয়েছে।প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় জয়পুরের বিখ্যাত মহারানী গায়েত্রী দেবী এই কোচ রাজবংশের কন্যা।যার জীবন হয়তো আপনারা আর কদিন পরে রুপোলি পর্দায় দেখতে পাবেন|যারা সত্যজিৎ রায়ের রয়াল বেঙ্গল রহস্য দেখেছেন তারা হয়তো কোচ রাজ্যের বা কোচ বিহারের ইতিহাস সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু তথ্য জানেন|কোচ বিহার বেড়াতে গেলে সবাই কোচবিহার রাজবাড়ি দেখতে যান, আমিও ব্যাতিক্রমী নই, চলুন এবার কোচবিহার রাজবাড়ি নিয়ে কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক|কোচবিহার রাজবাড়ি ১৮৮৭ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ-এর রাজত্বকালে তৈরি হয়। ভিক্টর জুবিলী প্যালেস’ নামেও পরিচিত এই রাজবাড়ি|লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসের আদলে এই রাজবাড়িটি নির্মিত|ভিতরে একটি ছোট্ট সুন্দর সুসজ্জিত উদ্যান রয়েছে এবং একটি পুকুর রয়েছে। যেখানে মাছ ছাড়াও কচ্ছপ দেখা যায়।রাজবাড়ি চত্বরে প্রবেশ করলে মনে হতে পারে আপনি টাইম মেশিনে চড়ে চলে গেছেন সুদূর অতীতের গৌরবময় এক সময়ে|প্রাসাদের মোট আয়তন ৫১,০০০ বর্গফুট। মূল কাঠামো ৩৯৫ ফুট লম্বা এবং ২৯৬ ফুট চওড়া। গোটা স্থাপত্য জুড়ে ইউরোপীয় রেনেসাঁস শৈলীর প্রভাব। প্রসাধন ঘর, শোয়ার ঘর, বসার ঘর, খাওয়ার ঘর, বিলিয়ার্ড ঘর, গ্রন্থাগার, তোষাখানা – এগুলোও দেখার মতো।না দেখলে কিন্তু আফসোস থেকে যাবে|কোচ বিহার রাজবাড়ি আর মদন মোহন মন্দির প্রায় সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে যা আজ গোটা বাংলার মানুষের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় তীর্থ ক্ষেত্র বলা যায়|বিশেষ করে রাস পূর্ণিমার সময়ে|শোনা যায় যে কোচবিহারের দ্বিতীয় মহারাজা বিক্রমাদিত্য নর নারায়ণ অসমের বৈষ্ণব ধর্মগুরু শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের নির্দেশানুসারে বংশীধারীর অষ্টধাতুর বিগ্রহ তৈরী করিয়েছিলেন যা পরবর্তীতে মদন মোহন নামে জগৎ প্রসিদ্ধ হয়|মদন মোহন মন্দিরে রাজপরিবারের কূলদেবতার বিগ্রহ সহ অন্যান্য দেবদেবীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মন্দিরের মোট পাঁচটি কক্ষ রয়েছে। একেক কক্ষে একেক দেবীর বিগ্রহ|রাজনৈতিক কারনে যখনই কোচ রাজারা নিজেদের রাজধানী স্থানান্তরিত করতেন, তখনই তাদের গৃহদেবতা শ্রী শ্রী মদনমোহন ঠাকুরেরও স্থান পরিবর্তন হত।তবে তবে বর্তমানে সেই রাজাও নেই রাজত্বও নেই, নেই সেই সাম্রাজ্যবাদের টানাপোড়েন, হানাহানি, তাই বহুকাল এই মদন মহন মন্দিরেই আছেন বংশীধারী|তার দর্শন দেহে মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা দেয়|আজ আমি নিজে অনুভব করলাম|চেষ্টা করলাম আপনাদের সাথেও ভাগ করে নিতে|শেষ করার আগে কোচ বিহারের বিখ্যাত রাস মেলা সম্পর্কে দুচার কথা না বললেই নয়, বর্তমানে এই মেলা আর শুধুমাত্র ধর্মীয় গন্ডীতে আবদ্ধ নেই, বরঞ্চ সামাজিক মিলন উৎসবে পরিনত হয়েছে , মেলায় একদিকে যেমন নানারকমের মনোহারি দোকান আসে, তেমনই থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। মন্দির চত্বরে নানারকম ভক্তিমূলক গান, পাঠ, কীর্তন প্রভৃতির ব্যবস্থা থাকে।সারা রাজ্য থেকেই প্রায় আসেন দর্শণার্থীরা|রাসের সময় আসতে পারেন সুযোগ পেলে|আগামী কাল যাওয়ার ইচ্ছে আছে কোচবিহারের বিখ্যাত বানেশ্বর মন্দিরে|তার গল্প ও ইতিহাস যথা সময়ে আবার ভাগ করে নেবো সঙ্গে থাকবে আমার অভিজ্ঞতা|পড়তে থাকুন|সঙ্গে থাকুন|ধন্যবাদ|