একান্ন পীঠ – বিমলা দেবী

69
শাস্ত্রে আছে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেবের তান্ডব নৃত্য থামাতে বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র পাঠিয়ে খণ্ডিত করেন সতীর দেহ। একান্নটি খন্ডে বিভক্ত সতীর দেহ একান্নটি স্থানে পতিত হয়। সেই একান্নটি স্থানে রয়েছে একান্নটি সতী পীঠ। আজ থেকে ধারাবাহিক ভাবে আলোচনা করবো এই একান্ন পীঠ নিয়ে। শুরু করছি জগন্নাথ ধাম পুরীতে অবস্থিত বিমলাদেবীর মন্দির নিয়ে।
পুরীর কথা উঠলেই আমাদের মাথায় আসে প্রভু জগন্নাথের নাম।তবে অনেকেই হয়তো জানেন না বা সেই ভাবে লক্ষ্য করেন না যে এই পুরীর জগন্নাথ মন্দির প্রাঙ্গনেই বিরাজ করছে একটি অন্যতম শক্তি পীঠ দেবী বিমলার মন্দির|জগন্নাথ মন্দির চত্ত্বরের দক্ষিণ পশ্চিম কোনে অবস্থান করছে দেবী বিমলার ছোট্ট কিন্তু সুন্দর এই মন্দির টি|শাক্ত ও তান্ত্রিক দের কাছে এই দেবী ও তার মন্দির অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ|মনে করা হয় দেবী বিমলা প্রভু জগন্নাথের রক্ষাকতৃ|জগন্নাথ দেবের পূজার পূর্বে দেবী বিমলার পূজা হয় এবং জগন্নাথ দেবের প্রসাদ বিমলা দেবীকে নিবেদন করার পর তা মহাপ্রসাদ হিসেবে গণ্য হয়|
বিমলা দেবীর মন্দিরটি জগন্নাথদেবের মন্দিরের থেকেও প্রাচীন|স্থাপত্য শৈলী ও প্রাচীনত্বের দিক থেকে বলা যায় সোমবংশী রাজবংশের রাজা যযাতি কেশরী এই মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন পরে তা সংস্কার হয় নানা সময়ে|এক কালে শৈব্য ও তান্ত্রিক দের প্রভাব এখানে বেশি ছিলো এমনকি দেবী কে আমিষ ভোগ ও দেয়া হতো পরে তা বন্ধ হয়|যদিও বিশেষ বিশেষ তিথিতে এখনো দেবী বিমলা কে আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়|জগন্নাথের মিনারের পশ্চিম কোনে বেলে পাথর ও ল্যাটেরাইট নির্মিত পূর্ব মুখী মন্দির টি অবস্থিত |মন্দিরটি চারটি অংশে বিভক্ত, সভা কক্ষ,গর্ভ গৃহ,উৎসব কক্ষ ও ভোগ বিতরন কক্ষ |পাশেই রয়েছে রোহিনী কুন্ড|বর্তমানে মন্দিরের রক্ষনাবেক্ষন এর দায়িত্বে রয়েছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া
কালিকা পুরাণ গ্রন্থে তন্ত্র-সাধনার কেন্দ্র হিসেবে যে চারটি প্রধান পীঠের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলি ভারতের চার দিকে অবস্থিত। এর মধ্যে পশ্চিম দিকের পীঠটি হল বিমলা দেবী পুরান মতে এখানে দেবী সতীর পা পতিত হয়েছিলো|এই পীঠের ভৈরব স্বয়ং জগন্নাথ কারন এখানে জগন্নাথদেব ও শিব অভিন্ন|এছাড়াও মহাপীঠ নির্ণয় তন্ত্র, বামন পুরান, মৎস পুরান ও দেবী ভাগবত পুরান ইত্যাদি গ্রন্থেও এই শক্তি পীঠের উল্লেখ আছে|তন্ত্রগ্রন্থ কুব্জিকাতন্ত্র মতে, বিমলা ৪২টি সিদ্ধপীঠের একটি| নামাষ্টোত্তরশত গ্রন্থেও দেবী বিমলার নাম পাওয়া যায়|যদিও এই পীঠের স্বরূপ এবং দেবীর দেহের কোন অংশ এখানে পতিত হয়েছিলো তা নিয়ে পন্ডিত দের মধ্যে ও কিছু গ্রন্থের মধ্যে কিঞ্চিৎ মত পার্থক্য ও বিরোধিতা আছে তবে এই শক্তি পীঠের অস্তিত্ব ও গুরুত্ব সর্বত্র স্বীকৃত|আদি শঙ্করাচার্য বিমলা দেবীকে শাস্ত্র মতে প্রতিষ্ঠা করে পুরীতে গোবর্ধন মঠ স্থাপন করেছিলেন|
মন্দিরের কেন্দ্রীয় গর্ভগৃহে রাখা আছে দেবী বিমলার মূর্তিটি। দেবী এখানে চতুর্ভূজা। তাঁর তিন হাতে জপমালা,বরমুদ্রা ও অমৃতকুম্ভ। চতুর্থ হাতের বস্তুটি ঠিক কী, তা এখনো স্পষ্ট নয় | তবে দেবী দুর্গার যে মূর্তি আমরা সচরাচর দেখতে অভ্যস্থ, দেবী বিমলার মূর্তি আদৌ সে রকম নয়। শুধু দেবী পার্বতীর দুই সখি জয়া ও বিজয়াকে দেবী বিমলার দুই পাশে দেখা যায়। মূর্তির উচ্চতা ৪ ফুটের কিছু বেশি।বিমলা মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ৬০ ফুট|
প্রতি বছর আশ্বিন মাসে ষোলো দিন ধরে দুর্গাপূজা উদ্‌যাপিত হয়|নানান উৎসবের মধ্যে দুর্গাপূজা বিমলা মন্দিরের প্রধান উৎসব|দুর্গাপূজার শেষ দিন, অর্থাৎ বিজয়াদশমীতে পুরীর রাজা প্রথা মেনে বিমলাকে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা রূপে পূজা করেন|এই প্রথা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে|
দেবী বিমলার কৃপা লাভ করতে আপনারা বিমলা দেবীর স্তুতি পাঠ করতে পারেন –
উৎকলে নাভি দেশশ্চ বিরজা ক্ষেত্র মুচ্যতে
বিমলা সা মহাদেবী জগন্নাথস্ত ভৈরব :
এবং পাঠ শেষে দেবী বিমলার উদ্দেশ্যে প্রণাম করে তাকে নিজের মনোস্কামনা জানাবেন।
আজ শক্তি পীঠ বিমলাদেবী নিয়ে আলোচনা এখানেই শেষ করলাম|ফিরে আসছি আগামী পর্বে পরবর্তী শক্তিপীঠ নিয়ে। পড়তে থাকুন।
ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।